শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (পঞ্চম পর্ব)
পূর্ববর্তী পর্বের লিংক : শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (চতুর্থ পর্ব)
এই ঘটনার পিছনে জিটা রাজ্যাক্স্যানি নামে হাঙ্গেরির এক তরুণী দাবাড়ুর বিরাট অবদান আছে। ববি ফিশার যে বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৭২ সালে জন্ম হয়েছিলো তার। মাত্র সতেরো বছর বয়সে হাঙ্গেরির জাতীয় যুব চেস চ্যাম্পিয়ান হওয়া ছাড়াও খুব ছোটবেলা থেকেই জিটা রাজ্যাক্স্যানি ছিলেন ববি ফিশারের অন্ধ ভক্ত। এই জিটা রাজ্যাক্স্যানি ১৯৯১ সালের শেষ দিকে দেখা করার অনুমতি চেয়ে ববি ফিশারের ঠিকানায় বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠান। প্রথম দিকে কোনো সাড়া না মিললেও ১৯৯২ সালের জানুয়ারি মাসে ববি ফিশারের কাছে থেকে জবাব পেলেন তিনি। শুধু তাই নয় বুদাপেস্ট থেকে লস এঞ্জেলস যাতায়াতের একজোড়া টিকিট ছাড়াও এক বনেদি হোটেলে এক সপ্তাহ থাকা খাওয়া সমেত অগ্রিম বুকিং মানির রশিদ ছিল খামের মধ্যে। ববি ফিশার দুঃখ প্রকাশ করে চিঠিতে লিখলেন তাঁর বাসস্থলে অতিথিদের থাকার প্রয়োজনীয় জায়গার অভাবের জন্যেই এই ব্যবস্থা করতে হয়েছে। তবে কোনো অসুবিধে হবে না। জিটা রাজ্যাক্স্যানি তার কোনো সঙ্গীকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে লস এঞ্জেলসে দিন সাতেক কাটিয়ে যেতে পারেন। সময় নষ্ট না করে সেই মাসের শেষ দিকে এক বান্ধবীকে নিয়ে জিটা লস এঞ্জেলসে এসে নির্ধারিত হোটেলে উঠলেন। পরদিন বিকেলে সেই হোটেলে এসে দেখা করলেন ফিশার। ববি ফিশারের চেহারায় তখন বেশ পরিবর্তন এসেছে। পোশাক আশাক, চেহারায় পারিপাট্যের অভাব স্পষ্ট। পায়ের জুতো বেশ পুরোনো। কথাবার্তাতে কিন্তু প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার ছাপ বোঝা যাচ্ছে। তার পরের দিন নিজেই লস এঞ্জেলস ঘুরিয়ে দেখালেন দুজনকে। জিটা লক্ষ্য করলেন ববি ফিশার পৃথিবীর সমস্ত ঘটনা নিয়ে সাবলীল ভাবে অনর্গল আলোচনা করলেও দাবা খেলা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করছেন না। তাছাড়াও সবচাইতে খারাপ লাগলো বারবার অনুরোধ করা সত্বেও ববি ফিশার কিছুতেই তাঁর নিজের বাসস্থানে নিয়ে যেতে চাইলেন না জিটা আর তাঁর বান্ধবীকে। প্রসঙ্গটা উঠলেই ববি ফিশার এড়িয়ে যেতেন। রহস্যটা বোঝার জন্যে হাঙ্গেরি ফেরার ঠিক দু’দিন আগে সকাল বেলায় বান্ধবীর সাথে একটা গাড়ি ভাড়া করে লস এঞ্জেলস থেকে অনেকটা দূরে পাসাডেনা এলেন জিটা। খুঁজে বার করলেন ববি ফিশারের আস্তানা। একটা ভাঙাচোরা হোটেলের দোতালায় ততোধিক জরাজীর্ণ একটা ঘর। দরজা নক করতেই ববি ফিশার বেরিয়ে এলেন। অপ্রস্তুতের একশেষ অবস্থা। জোর করে ঘরে ঢুকলেন জিটা রাজ্যাক্স্যানি। একটা নিতান্ত অপরিসর ছোট্ট কামরা। কায়ক্লেশে একজন মানুষ কোনোরকমে সেখানে শুধু শুতে পারে। মলিন দেয়ালের পাশে একটা বেঞ্চের মতো পাতা। সেখানে সার দিয়ে সাজানো প্রচুর ট্রফি, কাপ আর অসংখ্য মেমেন্টো। দেয়ালের গায়ে ঝুলছে বাঁধানো অনেক শংসাপত্র। মেঝেতে ছড়ানো স্তূপীকৃত পুরোনো বই আর ম্যাগাজিন। লজ্জায় মরে যাচ্ছেন তখন ববি ফিশার। একজন জীবিত কিংবদন্তির এরকম অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন হাঙ্গেরিয়ান তরুণী। খানিকটা ধাতস্ত হয়ে জিটা জানতে চাইলেন তাঁদের আসাযাওয়া আর হোটেলে থাকাখাওয়ার খরচা কি করে জোগাড় করলেন ফিশার। অনেক চাপাচাপিতে ফিশার স্বীকার করলেন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে সাময়িক ধার নিয়েছেন তিনি। তবে খুব তাড়াতাড়ি তিনি সেই সব মিটিয়ে দেবেন।
দুদিন বাদে বুদাপেস্ট ফিরে এসে জিটা রাজ্যাক্স্যানি দেখা করলেন ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন বা ফিডের জানোস কুবাট নামে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার সাথে। সেই সময় তিনি হাঙ্গেরীতেই ছিলেন। সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন জানোস কুবাট। ববি ফিশারকে কি করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় সেই নিয়ে প্রচুর আলোচনা করলেন দু’জন। জিটা বুঝেছিলেন ফিশার কোনো অবস্থাতেই কোনো চ্যারিটি বা দান গ্রহণ করবেন না। একটা উপায় মাথায় এলো শেষে। যদি কোনোরকমে ববি ফিশারকে প্রফেশনাল সার্কিটে ফিরিয়ে আনা যায় তবে সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব। ববি ফিশারের নাম শুনলে স্পন্সর করার মতো লোকের অভাব হবে না। তাছাড়া প্রাইজ মানির ব্যাপারটা তো আছেই। তাই একটা ম্যাচের আয়োজন করা প্রয়োজন। কিন্তু ফিশারের প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন। তাঁকে তো হতে হবে সমকক্ষ কেউ। নিদেনপক্ষে কোনো প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান। রাশিয়ান হলে ব্যাপারটা জমে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো রুশ দাবা ফেডারেশন অনুমোদিত কোনো প্লেয়ারের নাম শুনলেই ববি ফিশার পত্রপাঠ প্রস্তাবটা নাকচ করে দেবেন। আনাতোলি কারপভ বা গ্যারি কাসপারভের নাম বিবেচনা করা হলো না। শেষ পর্যন্ত উঠে এলো বরিস স্প্যাসকির কথা। একে তো তিনি তখনও ফ্রান্সের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে চলেছেন আর তার উপর রুশ দাবা ফেডারেশনের উপর তিনি বেজায় খাপ্পা। তাছাড়া ১৯৬৯ সালের ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়ান তিনি। বরিস স্প্যাসকিকে রাজি করানোর দায়িত্ব নিলেন জানোস কুবাট। তিনি রাশিয়ান নিউজ এজেন্সী (RIA)-কে প্রথমে খবরটা জানিয়ে যোগাযোগ করলেন বরিস স্প্যাসকির সাথে। স্প্যাসকি তখন ফ্রান্সের নাগরিক। সম্মতি জানালেন স্প্যাসকি। ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশনের এই ব্যাপারে কিছু করার ছিল না। কারণ, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফিডের নিজের অস্তিত্বই তখন সংকটের মুখে।
জিটা রাজ্যাক্স্যানি
এরপর জানোস কুবাট আর জিটা রাজ্যাক্স্যানি সার্বিয়ায় এসে দেখা করলেন যুগস্ক্যান্ডিক ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জেদিমির ভ্যাসেলজেভিকের সাথে। জেদিমির ভ্যাসেলজেভিক ছিলেন যুগোশ্লোভিয়ার অন্তর্গত সার্বিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিক-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষ। ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির মধ্যে প্রস্তাবিত রিপিট ম্যাচের কথা শুনেই তিনি এক কথায় স্পন্সর করতে রাজি হয়ে গেলেন। এই ম্যাচের জন্যে পাঁচ মিলিয়ান মার্কিন ডলারের পুরস্কার অর্থ ঘোষণা করে দিলেন তিনি। সেটাও আবার সম্পূর্ণ ট্যাক্স ফ্রি। শুধু সেদিন কেন আজ পর্যন্ত কোনো দাবা প্রতিযোগিতায় এতো বড়ো অংকের প্রাইজ মানির কথা কখনো শোনেনি কেউ। তবে শর্ত ছিল একটাই। ম্যাচ হবে যুগোশ্লোভিয়ায়।
এবার বাকি রইলো ববি ফিশারকে রাজি করানোর পালা। কারণ, তখনও পর্যন্ত তিনি এই ব্যাপারে কোনো কিছুই জানতেন না। ১৯৯২ সালের ২-রা জুলাই প্রস্তাবিত ম্যাচ নিয়ে ববি ফিশারের সাথে চূড়ান্ত কথাবার্তা বলার জন্যে জিটা রাজ্যাক্স্যানি, জানোস কুবাট আর যুগস্ক্যান্ডিক ব্যাংকের দুজন প্রতিনিধি লস এঞ্জেলসে এলেন। এর আগে জেদিমির ভ্যাসেলজেভিক তো দূরের কথা যুগস্ক্যান্ডিক ব্যাংকের নামই শোনেননি ফিশার। তাঁর তখন কপর্দকশূন্য অবস্থা। প্রথমে সামান্য ইতস্ততঃ করছিলেন। কিন্তু প্রাইজ মানির অংক শুনে বেশি চিন্তা না করে খেলার জন্যে সম্মতি জানালেন ববি ফিশার।
যে ববি ফিশার ১৯৭২ সালে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পর থেকে অফিসিয়ালি কোনো প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশ নেননি, তিনি কুড়ি বছর বাদে বরিস স্প্যাসকির বিরুদ্ধে একটা ফিরতি ম্যাচ খেলতে রাজি হলেন। অর্থাৎ ১৯৯২ সালের এই লড়াইটা প্রকারান্তরে হয়ে দাঁড়ালো ১৯৭২ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের রিপ্লে মানে ফিরতি ম্যাচ। বরিস স্প্যাসকির কাছেও একটা সুযোগ চলে এলো কুড়ি বছর আগের হারের একটা বদলা নেওয়ার। তাই তাঁর রাজি হওয়ার পিছনে সঙ্গত কারণ ছিল।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অন্য একটা জায়গায়। সেটা ছিল বলকান গৃহযুদ্ধের সময়। সেই সময় মন্টিনিগ্রোর সমুদ্রোপকূলে সেন্ট স্টিফান দ্বীপের থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে বসনিয়াতে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। সেই গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকার সাথে যুগোস্লাভিয়ার কূটনৈতিক স্তরে সম্পর্ক খুব তিক্ত হয়ে উঠেছে। ফলে যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত সার্বিয়া আর মন্টিনিগ্রোতে বেশ কিছু বিধিনিষেধ লাগু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯২ সালের ৫-ই জুন আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর থেকে বিশেষ সার্কুলার জারি করে সমস্ত মার্কিন নাগরিকদের সার্বিয়া আর মন্টিনিগ্রোতে কোনো রকম প্রতিযোগিতা বা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যুক্ত থাকার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।
১৯৯২ সালের ১১-ই জুলাই যৌথ চুক্তিপত্রে সই করলেন ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকি। ববি ফিশার দাবি করলেন তিনিই এখনো অপরাজিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান। কারণ, ১৯৭৫ সালে অন্যায় ভাবে তাঁর খেতাব বাজেয়াপ্ত করে আনাতোলি কারপভকে জয়ী ঘোষণা করেছিল ফেডারেশন। ববি ফিশারকে পরাস্ত করে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান হননি কারপভ। তাই তাঁর দাবি মতো এই ম্যাচটাকে আনঅফিশিয়ালি ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ নামে প্রচার করতে রাজি হলেন উদ্যোক্তারা।
ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির মধ্যে যুগোস্লাভিয়ায় প্রস্তাবিত ম্যাচের খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের কাছে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। এদিকে আগস্ট মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে বসনিয়ায় আট হাজারেরও বেশি মানুষ গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারান। ফলে ওয়াশিংটনে অবস্থিত ‘অফিস অফ ফরেন এসেট কন্ট্রোল’-এর ডিরেক্টর রিচার্ড নিউকম্ব সরকারিভাবে খুব কড়া ভাষায় নোটিস পাঠালেন ববি ফিশারের কাছে। সেখানে পরিষ্কারভাবে ববি ফিশারকে যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত কোনো দেশে কোনরকম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা বা যুক্ত হওয়ার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এটাও সেখানে উল্লেখ করা ছিল যদি তিনি এই আদেশ অমান্য করেন তবে শাস্তি হিসাবে তাঁর কাছ থেকে সর্বাধিক আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার জরিমানা আদায় কিংবা দশ বছরের কারাবাস অথবা দুটোই একসাথে কার্যকর করতে বাধ্য হবে মার্কিন সরকার। নোটিসের জবাব দেওয়ার জন্যে দশ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হলো। বলা বাহুল্য, নোটিসের কোনো উত্তরই দিলেন না ববি ফিশার।
এদিকে সেই সময় পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে বিরাট এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। তখন আর ‘দ্য ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাব্লিকস’ বা সংক্ষেপে ‘ইউ এস এস আর’ বলে কিছু নেই। ১৯৯১ সালের ২৫-শে ডিসেম্বর সোভিয়েত রাশিয়ার শেষ প্রেসিডেন্ট হিসাবে মিখাইল গর্বাচভের পদত্যাগ পত্রে সই করলেন। ভেঙে পড়লো বহুদিন ধরে বেড়ে ওঠা সোভিয়েত সাম্রাজ্য। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে জন্ম নিলো স্বাধীন পনেরোটা রাষ্ট্র। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, এস্তনিয়া, জর্জিয়া, কাজাখিস্তান, কিরজিখিস্তান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, মালদোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কিমিনেস্তান ও উজবেকিস্তান।এর পশ্চাৎপটে এক বিরাট ইতিহাস আছে। এখানে বিস্তারিত ভাবে সেইসব আলোচনায় গেলাম না। ১৯৯১ সালের ২৬-শে ডিসেম্বর নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে বরিস ইয়েলেৎসিন রাশিয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করার সাথে সাথে স্বাভাবিক কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে চলে আসা ঠাণ্ডা-যুদ্ধও শেষ হয়ে গেলো। সোভিয়েত রাশিয়ার গোপন গুপ্তচর এজেন্সি ‘কে জি বি’-র কোনো অস্তিত্বই রইলো না। এর একটা অবশ্যম্ভাবী কুফল অবশ্যই ছিল। সাড়া পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য টালমাটাল হয়ে গেলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তিশালী কোনো দেশই আর রইলো না। ঠিক তখন থেকেই সারা বিশ্ব জুড়ে শুরু হলো আমেরিকার দাদাগিরি।
এর কিছুদিন আগেই ১৯৯০ সালের ৩-রা অক্টোবর পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে গেছে। সোভিয়েত কর্তৃত্বকে অগ্রাহ্য করে ১৯৯০ সালের ১৩-ই জুন বার্লিন প্রাচীর ভেঙে ফেলার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মানুষজন। ১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যেই সেটা সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। পৃথিবী জুড়ে কম্যুনিজম-এর আধিপত্য তখন খানিকটা স্তিমিত। বাদ গেলো না যুগোস্লাভিয়াও। ৯০-এর দশকের প্রথমেই মোট সাতটা দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা যুগোস্লাভিয়া ভেঙে স্লোভানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া আর হার্জেগোভিনা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলো। তাই ১৯৯২ সালের সেই সময়টায় শুধু সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘সোসালিষ্ট ফেডারেল রিপাবলিক অফ যুগোস্লাভিয়া’ নাম দিয়ে দেশটার অস্তিত্ব শুধু টিকিয়ে রেখেছে। যদিও বেশ কয়েক বছর বাদে ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে গেলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে যুগোস্লাভিয়া নামটাই সম্পূর্ণ মুছে যায়। পরে আবার সার্বিয়া ভেঙ্গে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সার্বিয়া আর কসোভো। সেগুলো অবশ্য আলাদা ইতিহাস।
আবার ফিরে আসি ১৯৯২ সালের ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির সেই বিতর্কিত ম্যাচের কাহিনীতে। গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ম্যাচ শুরু হবে যুগোশ্লোভিয়ার মন্টিনিগ্রো স্টেটের সমুদ্র উপকূলের সেন্ট স্টিফান দ্বীপে। এই দ্বীপের প্রাসাদোপম আর প্রচণ্ড বিলাসবহুল মায়েস্ত্রাল হোটেলের দোতলার বিশাল বলরুমকে ম্যাচ খেলার জন্যে বেছে নেওয়া হলো। এই হোটেলেই দুটো সুসজ্জিত স্যুইট বুক করে রাখা হলো ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির জন্যে। একতলায় ব্যবস্থা করা হলো সাংবাদিক সম্মেলনের। এই মায়েস্ত্রাল হোটেলের একটা প্রাচীন ইতিহাস আছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক প্রাচীন দুর্গকে সংস্কার করে গড়ে উঠেছিল এই হোটেল। একসময় মার্শাল টিটো মন্টিনিগ্রোতে এলে সেন্ট স্টিফান দ্বীপের মায়েস্ত্রাল হোটেলে এসে থাকতেন।
ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির সম্মতি নিয়ে কতকগুলো বিশেষ নিয়ম ঠিক করা হলো। যে কোনো পক্ষ প্রথম পাঁচ রাউন্ড জিতে গেলে দশ দিনের বিরতি দিয়ে পুনরায় খেলা আরম্ভ হবে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে। প্রতি সপ্তাহে চার দিন মানে বুধবার, বৃহস্পতিবার, শনিবার আর রবিবার বেলা সাড়ে তিনটের সময় রাউন্ড শুরু করতে হবে আর পূর্ণ ফলাফল না আসা পর্যন্ত খেলা মুলতুবি ঘোষণা করা যাবে না। যদি কোনো রাউন্ড প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায় অথবা দুই পক্ষের সহমতের ভিত্তিতে গেম ড্র বলে ঘোষণা করা হয় তবে কোনো সময় নষ্ট না করে তখনি পরের রাউন্ড শুরু হয়ে যাবে। প্রথম তিরিশ রাউন্ডের মধ্যে যে কোনো পক্ষ একমাত্র ম্যাচ হেলথ কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বাধিক চারবার অসুস্থতার কারণে গেম স্থগিত রাখার আবেদন জানাতে পারবেন। শুধুমাত্র সোমবার প্রেস কনফারেন্সে ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকি সাংবাদিককদের মুখোমুখি হবেন। ববি ফিশারের কাছ থেকে কিছু জানতে চাইলে আগে থেকে লিখিত ভাবে প্রশ্নাবলী জানিয়ে রাখতে হবে। বরিস স্প্যাসকিকে অবশ্য মৌখিক ভাবে প্রশ্ন করতে পারবেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। মোট ৫ মিলিয়ান মার্কিন ডলার পুরস্কার মূল্যের মধ্যে জয়ী খেলোয়াড় পাবেন ৩.৩৫ মিলিয়ান ডলার আর বিজিত পক্ষ পাবেন ১.৬৫ মিলিয়ান ডলার।
এছাড়াও সময় সংক্রান্ত আরো বিশেষ কিছু নিয়ম বলবৎ করা হলো। প্রথম এক ঘণ্টা একান্ন মিনিটে প্রত্যেককেই অন্তত পক্ষে পঞ্চাশটা চাল দিতে হবে। প্রথম চল্লিশ চালের পর দুপক্ষই অতিরিক্ত চল্লিশ মিনিট, ষাঠ চালের পর তিরিশ আর আশি চালের পর থেকে প্রতি কুড়ি চালের জন্যে কুড়ি মিনিট করে বোনাস টাইম পাবেন। এছাড়াও ববি ফিশারের দাবি অনুযায়ী একটা বিশেষ ঘড়ি বসানো হলো দাবার টেবিলে। এই ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে। ১৯৮৯ সালে ববি ফিশার চেস খেলায় দুপক্ষের চাল দেওয়ার সময় মাপার জন্যে জোড়া ডায়ালের একটা টেবিল ঘড়ি বানিয়ে পেটেন্টের আবেদন করেছিলেন। দুটো ডায়ালের উপরই ঘন্টি বাজানোর সুইচ থাকায় প্রত্যেক খেলোয়াড় বোতাম টিপে নিজের চাল দিলে আলাদা করে প্রত্যেকটা চালের সময় মাপা যেত। নির্ধারিত সময়ের আগে কেউ চাল শেষ করলে সেকেন্ডের হিসাবে অবশিষ্ট সময়ের আলাদা রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা ছিল এই ঘড়িতে। মজার ব্যাপার হলো ‘ফিশার ক্লক’ নামে এই ঘড়িটার পেটেন্ট স্বীকৃত হয়েছিল এই ম্যাচের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। নিয়ম করা হলো যদি এই ঘড়ি অনুযায়ী কোনো পক্ষ এক মিনিটের কম সময়ে কোনো চাল দিতে পারে তাহলে সেকেন্ডের মাপে বাকি অংশটাও বোনাস টাইম হিসাবে সেই খেলোয়াড়ের নির্ধারিত সময়ের সাথে যোগ করা হবে। অতিরিক্ত সময় পাওয়ায় ফলে টাইম আউট হয়ে হেরে যাবার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কমবে। বস্তুত এই ম্যাচে প্রথমবারের মত এই ঘড়ি ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীকালে আর আজ পর্যন্ত সমস্ত রকম অফিসিয়াল চেস টুর্নামেন্টে ‘ফিশার ক্লক’ আবশ্যিক করা হয়েছে।
১৯৯২ সালের এই ম্যাচেও রেফারি হিসাবে নিযুক্ত হলেন ১৯৭২ সালের ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ রেফারি জার্মান গ্র্যান্ডমাস্টার লোথার স্কিমিড। ববি ফিশার তাঁর সেকেন্ডস মানে সহায়ক হিসাবে বেছে নিলেন ফিলিপিন্সের গ্র্যান্ডমাস্টার ইউজিনিও তোরে-কে। আর বরিস স্প্যাসকির সহায়ক হিসাবে থাকলেন তিনজন গ্র্যান্ড মাস্টার। রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার আলেক্সান্ডার নিকিতিন, ইউরি বালাশভ আর সার্বিয়ার গ্র্যান্ডমাস্টার বরিশ্লভ ইভকভ।
কোনো পক্ষ দশ রাউন্ড না জেতা পর্যন্ত ববি ফিশার ম্যাচ চালু রাখার দাবি জানালেও উভয়ের সম্মতিক্রমে সর্বাধিক রাউন্ডের সংখ্যা ৩৬ নির্দিষ্ট করা হলো।
১৯৯২ সালের ১-লা সেপ্টেম্বর প্রায় কুড়ি বছর বাদে এই প্রথম মন্টিনিগ্রোর সেন্ট স্টিফান দ্বীপে মায়েস্ত্রাল হোটেলে সকাল দশটায় সাংবাদিক সম্মেলনে দেশ বিদেশের অসংখ্য সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের মুখোমুখি হলেন ববি ফিশার। পাশে ঝলমলে পোশাকে জিটা রাজ্যাক্স্যানি। বরিস স্প্যাসকিও উপস্থিত সেখানে। আগে ছবিতে দেখে থাকলেও সংবাদ মাধ্যমের বেশির ভাগ প্রতিনিধির কাছে ববি ফিশারকে চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতা ছিল প্রথম। দুজনেই ছিলেন সপ্রতিভ আর হাসিখুশি। তবে ববি ফিশারের চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসে গেছে। ১৯৭২ সালের সেই একমাথা সোনালী চুলের ঋজু দীর্ঘদেহী ঝকঝকে এক আমেরিকান তরুণের ছবিটার সাথে এখনকার চেহারায় মিল খুঁজে পাওয়া গেলো না। মাথার চুল অনেকটাই অদৃশ্য। মুখে অকাল বলিরেখার ছাপ স্পষ্ট। শরীরে খানিকটা মেদের আধিক্য। তবে চলাফেরা আর আদবকায়দায় তখনও তিনি প্রচণ্ড স্মার্ট। তুলনায় বরিস স্প্যাসকির চেহারায় আগের তুলনায় পরিবর্তন এসেছে সামান্য। চুলে অবশ্য খানিকটা পাক ধরেছে। হাসি মুখে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন দুজনেই। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন ঘটলো যখন ওয়াশিংটন থেকে জারি করা সেই নোটিসের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন তুললেন ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর এক তরুণ আমেরিকান সাংবাদিক। মুহূর্তের মধ্যেই ববি ফিশার প্রচণ্ড রেগে পকেট থেকে সেই নোটিস বার করে সবার সামনে ছিঁড়ে ফেললেন। শুধু তাই নয় ছেঁড়া টুকরোগুলোর উপর থুথু ছিটিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন এটাই তাঁর জবাব। ‘সিএনএন’-এর টিভি ক্যামেরায় বন্দী হলো সম্পূর্ণ দৃশ্যটা। হোয়াইট হাউসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় সমস্ত ঘটনাটা দেখলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। এই ঘটনার ঠিক এক ঘণ্টা বাদে ববি ফিশারের মার্কিন নাগরিকত্ব খারিজ করে দিলো আমেরিকা। এছাড়াও চিরদিনের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন প্রশাসন।
১৯৯২ সালের দোসরা সেপ্টেম্বর বুধবার, মন্টিনিগ্রোর সেন্ট স্টিফান দ্বীপে মায়েস্ত্রাল হোটেলের দোতলার বিশাল হলে দুপুর তিনটের কিছু আগেই সহকারীদের সাথে নিয়ে পৌঁছালেন বরিস স্প্যাসকি আর ববি ফিশার। খেলার হলে কোনো টিভি ক্যামেরা বসানো না থাকলেও মাঝখানের টেবিল থেকে অনেকটা দূরে একপাশে আমেরিকা সমেত দেশ বিদেশের অসংখ্য সাংবাদিক। মন্টিনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট মিলো দুকানোভিক আর ম্যাচ স্পন্সরার যুগস্ক্যান্ডিক ব্যাংকের কর্ণধার জেদিমির ভ্যাসেলজেভিক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার প্রচুর রাজনৈতিক তথা বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষজন। টেবিলের ঠিক মাঝখানে দর্শকদের দিকে মুখ করে অর্ধবৃত্তাকারে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ’ লেখা আড়াআড়ি ভাবে বোর্ড লাগানো। লেখার মাঝখানে যুগস্ক্যান্ডিক ব্যাংকের লোগো। হলের মাঝখানে টেবিলের ঠিক পিছনের দেয়ালেও বিশাল ব্যানারে একই কথা লেখা। সেন্টার টেবিলের পেছন ঘেঁষে ববি ফিশারের সামনে ‘ইউ এস এ’-এর ছোট জাতীয় পতাকা লাগানো। একই সাইজের ফ্রান্সের পতাকা বরিস স্প্যাসকির সামনে। অনেক দূরে সম্পূর্ণ কাঁচ দিয়ে একটা ঘেরা উঁচু জায়গায় রেডিও ও টিভির ধারাভাষ্যকারেরা সারি দিয়ে বসে আছেন। প্রাথমিক করমর্দন সেরে ঘড়িতে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটের সময় পঞ্চান্ন বছর বয়সী বরিস স্প্যাসকি মুখোমুখি হলেন তাঁর থেকে ছবছরের ছোট উনপঞ্চাশ বছরের ববি ফিশারের।
মন্টিনিগ্রোয় ১৯৯২ সালের বেসরকারি ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচে মুখোমুখি ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকি|
এদিকে ঠিক এক ঘণ্টা আগে স্থানীয় ঘড়িতে বেলা আড়াইটার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ববি ফিশারের এরেস্ট ওয়ারেন্টে সই করে দিয়েছেন। তবে আমেরিকার জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ‘এফ বি আই’-কে সেটা ফিশার স্প্যাসকির ম্যাচ পর্বের শেষে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হলো। এর পিছনে অবশ্য একটা অন্য কারণও ছিল। সেদিন সকালেই জেদিমির ভ্যাসেলজেভিক বসনিয়ার গৃহযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্যে এই ম্যাচের টিভি ও অন্যান্য বিজ্ঞাপন স্বত্ব বাবদ পাওয়া অর্থ থেকে পাঁচ লক্ষ মার্কিন ডলার মূল্যের আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেদিক থেকে দেখলে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগেই ববি ফিশারকে গ্রেফতার করলে আন্তর্জাতিক মহলে আমেরিকার এই নেতিবাচক ভূমিকার সমালোচনা হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিল।
মন্টিনিগ্রোর হোটেলে বসে স্থানীয় টিভি চ্যানেলে খবরটা শুনেছিলেন ফিশার। তবে ববি ফিশারের এতে কিছু এলোগেলো না। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধাতের মানুষ। চেস বোর্ডের পাশে রাখা দুই ডায়ালের ঘড়ির মাথায় বসলো বোতাম টিপে সাদা ঘুঁটি নিয়ে প্রথম রাউন্ডের খেলা শুরু করলেন তিনি।
প্রচারের আলোয় সার্চ লাইটের নিচে তখন শুধু ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকি। আনাতোলি কারপভ আর গ্যারি কাসপারভরা কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন তখন।
পরবর্তী পর্বের লিংক : শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (ষষ্ঠ পর্ব)
মন্তব্য তালিকা - “শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (পঞ্চম পর্ব)”