সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (তৃতীয় পর্ব)

শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (তৃতীয় পর্ব)

আগস্ট ১২, ২০২০ ১৩১৭ 0

পূর্ববর্তী পর্বের লিংক: শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (দ্বিতীয় পর্ব)

এমনিতে ভারতবর্ষে দাবার ইতিহাস যথেষ্ট পুরনো। ষষ্ঠ শতাব্দীর আগেই ভারতে সম্ভবত গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলে দাবা খেলার প্রচলন শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল ‘চতুরঙ্গ’। পরে ভারত থেকে খেলাটা আমদানি হয় পারস্য বা আধুনিক ইরানে। সেখানে আবার খেলাটার নাম দেওয়া হয় ‘শতরঞ্জ’। পরে ইরান দখল করার পর আরবরা এই খেলাটার সাথে পরিচিত হয়। ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাটরাও ‘শতরঞ্জ’ খেলতে উৎসাহী ছিলেন। তবে তখন খেলাটা সীমাবদ্ধ ছিল দরবারের আমির ওমরাহ আর ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এরপর মুঘল ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই দাবা খেলা চলে আসে দক্ষিণ ইউরোপে। তারপর ইউরোপ থেকেই এই খেলাটা মূলত আজকের আধুনিক দাবার রূপ নেয়। দাবা খেলায়‘ চেকমেট’ শব্দটা খুব সম্ভব ইরানে প্রচলিত ‘শাহ মাত’ কথাটা থেকেই এেছে ।

ভারতবর্ষে মুঘল দরবারের সীমানা পেরিয়ে ধীরে ধীরে খেলাটা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, আর ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যদিও এই খেলায় মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের অংশগ্রহণের হার ছিল অনেক বেশী, তবুও নারী পুরুষ নির্বিশেষে দেশের আপামর জনসাধারনণের কাছে অল্প বিস্তর দাবা খেলার একটা পরিচিতি ছিলই। তাই ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির মধ্যে লড়াইয়ের উন্মাদনার আঁচ এসে পড়েছিল ভারতের প্রত্যেকটা জায়গায়, প্রতিটা অংশে।

বাদ যায়নি কলকাতাও। হাতে গোনা অতি উৎসাহী কিছু স্কুল কলেজের ছাত্রের মধ্যে দাবা খেলার প্রচলন থাকলেও তখনও পাড়ায় পাড়ায় কিছু বয়স্ক মানুষজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল খেলাটা। কোনো সন্দেহ নেই বরিস স্প্যাসকি আর ববি ফিশারের এই লড়াই বয়েস নির্বিশেষে সবার মধ্যেই একটা প্রবল উৎসাহ সঞ্চার করতে সমর্থ হয়েছিল। বহুল প্রচলিত বাংলা দৈনিক খবরের কাগজগুলোয় নিয়মিত ভাবে ছাপা হতো স্প্যাসকি বনাম ফিশারের ম্যাচের খবর। পিছিয়ে থাকেনি শুকতারা, শিশুসাথী, কিশোর ভারতীর মতো ছোটদের মাসিক পত্রিকাগুলোও। সেখানে প্রায় প্রতিটা সংখ্যায় ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির ছবি ছাপিয়ে ছোটদের মতো করে নিবন্ধ প্রকাশিত হতে লাগলো। ফলে আট থেকে আশি সবার কাছে ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। প্রত্যেকটা রাউন্ডের দু’দিন বাদে সব কটা কাগজেই সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে খেলার স্কোর ছাপা হতো। সেইগুলি পাঠোদ্ধার করা দুরূহ হতো বলে বেশির ভাগ ছেলে বুড়ো খবরের কাগজের পাতা নিয়ে হাজির হতো পাড়ার সেই সমস্ত হাতে গোনা দাবাড়ুদের কাছে। এর আগে পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষই দাবা খেলাটাকে লুডো খেলার চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেন না। ফলে সমাজের সেই অপাংক্তেয় মুষ্টিমেয় কিছু দাবাড়ু মানুষ রাতারাতি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। তাঁরাও তাঁদের মতো স্কোর কার্ড বিশ্লেষণ করে খেলাটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর রাখতেন না। নিজে নিজেই দাবা খেলা আর তার নিয়ম কানুন শেখার কিছু চটি ইংরেজি বই পাওয়া যেত বাজারে। কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো সব আউট অফ স্টক হয়ে গেলো। কিছু বুদ্ধিমান প্রকাশক এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তারা বাংলাতেও ছাপিয়ে ফেললেন দাবা খেলা শেখার বই।  অল্প বিস্তর খেলাটা শিখে নিলো সবাই। ফলে যথারীতি ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির  বাঙালি সমর্থকরা দুই শিবিরে ভাগ ভাগ হয়ে গেলো। বাসে, ট্রামে, স্কুল কলেজে,  অফিসে, চায়ের দোকানে তখন প্রচুর বিশেষজ্ঞ তাঁদের নিজেদের মতামত দিয়ে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করলেন। খেলার সরঞ্জাম বিক্রির দোকানগুলোয় দাবা বোর্ডের চাহিদা তখন তুঙ্গে। অলিতে গলিতে বিভিন্ন ক্লাবে ক্যারাম আর টেবিল টেনিসের পাশাপাশি দাবার বোর্ড পেতে বসে গেলেন অনেকে। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে এতদিন ধরে যে খেলাটা সমাজের সামান্য একটা অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সেটাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল ১৯৭২ সালে আইসল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ববি ফিশার আর বরিস স্প্যাসকির সেই ঐতিহাসিক দ্বৈরথ। এখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পরবর্তীকালের বহু বাঙালি তথা ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার।

যাই হোক, আবার ফিরে যাই আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিকে। চব্বিশ রাউন্ডের মধ্যে সবে ছয় রাউন্ড শেষ হয়েছে। এখনো আঠেরো রাউন্ড খেলা বাকি। মোট পয়েন্টের হিসাবে স্প্যাসকি ম্যাচ সমান সমান রাখতে পারলেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব তিনি ধরে রাখতে পারবেন। কিন্তু ববি ফিশারকে খেতাব ছিনিয়ে নিতে হলে জিততেই হবে।

সপ্তম রাউন্ড শুরু হলো ২৫-শে জুলাই রবিবার সকালে। বরিস স্প্যাসকি সাদা ঘুঁটি নিয়ে শুরু করলেও প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ভাবে খেলতে শুরু করেন ফিশার। সতেরো নম্বর চালের পর প্রায় জেতার মতো অবস্থায় পৌঁছে যান তিনি। কিন্তু তাঁর পরেই খানিকটা হালকা ভাবে খেলে ৪৯-তম চালের মাথায় জেতা গেমটা ড্র করে বসলেন ববি ফিশার।

আর বেশি বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। এরপর অষ্টম, দশম আর তেরো নম্বর রাউন্ড জেতেন ফিশার। মাঝে শুধু একাদশ রাউন্ডে স্প্যাসকি জিতে যান। এছাড়া কুড়ি রাউন্ড পর্যন্ত বাকি খেলা গুলো ড্র হয়ে যায়। কুড়ি রাউন্ডের শেষে ববি ফিশারের পয়েন্ট দাঁড়ায় সাড়ে এগারো আর বরিস স্প্যাসকির সাড়ে আট।

৩১-শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার সকালে একুশ নম্বর রাউন্ডে মুখোমুখি বসলেন স্প্যাসকি আর ফিশার। পয়েন্ট টেবিলের অবস্থা তখন এমন যে বাকি চারটে রাউন্ডের সবকটাই না জিতলে বরিস স্প্যাসকির পক্ষে বিশ্বখেতাব ধরে রাখা সম্ভব হবে না। থমথমে মুখে সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলা শুরু করলেন স্প্যাসকি। ববি ফিশার লড়ে গেলেন সমানে সমানে। ছয় ঘণ্টা জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরুদ্ধকর এই রাউন্ডে ফিশারের ৪১-তম চালের মাথায় বাকিটা পরের দিন খেলা হবে ঘোষণা করে সেদিনের মতো রাউন্ড মুলতবি ঘোষণা করা হলো। বিশেষজ্ঞরা বুঝে গেলেন গেম ফিশারের পক্ষে চলে গিয়েছে। পরদিন পয়লা সেপ্টেম্বর খেলা শুরু হওয়ার আগে বরিস স্প্যাসকি ফেডারেশনকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন তিনি আসছেন না। হার মেনে নিলেন তিনি। ফলে ২১ রাউন্ডেই শেষ হয়ে গেলো ম্যাচ। স্কোর কার্ডে লেখা হলো ববি ফিশার সাড়ে বারো আর বরিস স্প্যাসকির সাড়ে আট পয়েন্ট। ববি ফিশার সাত রাউন্ড আর একটা ওয়াকওভার ধরে বরিস স্প্যাসকি জিতেছিলেন তিন রাউন্ড। মোট এগারোটা রাউন্ড ড্র হয়।

১৯৭২ সালের ৩-রা সেপ্টেম্বর সরকারিভাবে ববি ফিশারকে একাদশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হিসাবে ঘোষণা করে ইন্টারন্যাশনাল চেস ফেডারেশন। এই উপলক্ষে ববি ফিশারের জন্যে আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিক শহরে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বরিস স্প্যাসকিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি সেই অনুষ্ঠানে আসেননি। পরাজিত সম্রাট মস্কো ফিরে গেলেন।

খেতাব হারিয়েও বরিস স্প্যাসকি এই ম্যাচ থেকে প্রাইজ মানি হিসাবে ৯৩৭৫০ মার্কিন ডলার পেয়েছিলেন। যা ছিল দেশ বিদেশ মিলিয়ে তাঁর আগে অংশ নেওয়া সমস্ত রকম প্রতিযোগিতা থেকে প্রাপ্ত মোট অর্থ-পুরস্কারের থেকে অনেক বেশি। এর আগে সোভিয়েত রাশিয়ার বাইরে কোনো টুর্নামেন্টে খেলে বরিস স্প্যাসকির সর্বাধিক প্রাইজ মানির পরিমাণ ছিল মাত্র পাঁচ হাজার ডলার।

ববি ফিশার আমেরিকা ফিরে আসার পর ‘লস এঞ্জেলস টাইমস’ পেপারের কাটিং

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব আর বিরাট অংকের প্রাইজ মানি নিয়ে ববি ফিশার আমেরিকা ফিরলেন। নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে তাঁকে বিশাল সম্বর্ধনা দেওয়া ছাড়াও সরকারি নির্দেশে পরদিন সারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ‘ববি ফিশার ডে’ পালিত হলো। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সান্ধ্য ভোজে অভ্যর্থনা জানালেন ববি ফিশারকে। জনপ্রিয়তার নিরিখে সেই সময় আমেরিকায় ফিশার তখন সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। স্বাভাবিক কারনেণই প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা তাদের পণ্যের বিপণনের জন্যে বিজ্ঞাপনের মডেল হিসাবে ববি ফিশারের সাথে চুক্তি করতে উঠেপড়ে লাগলো। সব মিলিয়ে সেই সব চুক্তির অর্থমূল্য ছিল পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। কিন্তু ববি ফিশার সেই সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। বরং ১৯৭৩ সালে তিনি তাঁর বিশ্ব খেতাবি লড়াইয়ের প্রাপ্ত প্রাইজ মানি থেকে ৬১২০০ ডলার নর্থ ক্যালোরিনায় অবস্থিত ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চ অফ গড’-এর চ্যারিটি ফান্ডে দান করেন। এখন অবশ্য সেই সংস্থার নাম পাল্টে ‘গ্রেস কম্যুনিয়ন ইন্টারন্যাশনাল’ করা হয়েছে। বিখ্যাত ‘স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড’ আর ‘লাইফ’  ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে সাঁতারু মার্ক স্পিৎস-এর পর দ্বিতীয় আমেরিকান খেলোয়াড় হিসাবে ববি ফিশারের ছবি ছাপানো হলো। বহু বিখ্যাত টেলিভিশন অনুষ্ঠান যেমন ‘ডিক ক্যাভেট শো’ বা ‘বব হোপ টিভি স্পেশাল’-এ নিয়মিত হাজির থাকতে লাগলেন ফিশার। সঞ্চালকদের সাথে হাসি মস্করা করা ছাড়াও যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতেন সাবলীল ভাবে। খুব সহজ ভাবে চেস খেলার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনাতেও অংশ নিতেন তিনি। সমস্ত মার্কিন মুলুকে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে দাবা খেলা। ফলে ১৯৭২ সালেই মার্কিন চেস ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমেরিকার বহু মানুষ সংস্থার সাথে যুক্ত হতে আরম্ভ করেন আর ১৯৭৪ সালে সভ্য সংখ্যার নিরিখে ফেডারেশনের সর্বকালীন এক নতুন রেকর্ড তৈরী হয়। আমেরিকার বাইরে অন্য দেশগুলোতেও এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তাই দাবা খেলার ইতিহাসে ১৯৭২ থেকে ৭৪ পর্যন্ত এই সময়টাকে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই ‘ফিশার বুম’ বলে উল্লেখ করেছেন।

নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ববি ফিশার

এদিকে মস্কোয় ফিরে এসে ঘরে বাইরে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়লেন বরিস স্প্যাসকি। তিনি নিজেও তো একজন বিরল প্রতিভাধর জিনিয়াস ছিলেন। তাঁর নিজের স্বাভিমানেও কোথাও একটা ঘা লেগেছিলো। তাই ববি ফিশারের কাছ থেকে খেতাব পুনরুদ্ধারের জন্যে তিনি তখন মরিয়া। সুযোগও চলে এলো। দাবা দুনিয়ার নিয়ম অনুযায়ী নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জার বাছার জন্যে ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে তিনি প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হিসাবে আর আগেরবারের রানার আপ টাইগার পেট্রোসিয়ান সরাসরি অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেন। পুয়ের্তো রিকোর রাজধানী সান জুয়ান-এ সেই বছর জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে মার্কিন দাবাড়ু রবার্ট বার্নকে উড়িয়ে দিলেন স্প্যাসকি। কিন্তু এপ্রিল মাসে লেনিনগ্রাদের সেমিফাইনাল ম্যাচে বরিস স্প্যাসকি বিচ্ছিরি ভাবে হেরে গেলেন তার থেকে চোদ্দ বছরের ছোট সোভিয়েত রাশিয়ার নতুন নক্ষত্র আনাতোলি কারপভের কাছে। শেষ পর্যন্ত সেই বছরই সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস জুড়ে মস্কোতে আয়োজিত ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের ফাইনালে ভিক্টর করশনয়কে হারিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জার হিসাবে উঠে এলেন রাশিয়ার নতুন প্রতিভা আনাতোলি কারপভ। ১৯৭৫ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের রণভূমি হিসাবে এবার বেছে নেওয়া হলো ফিলিপিন্স-এর রাজধানী ম্যানিলা-কে। যথারীতি দিনক্ষণ জানিয়ে নিয়ম মাফিক চিঠি পাঠানো হলো ববি ফিশারের কাছে।

এদিকে ববি ফিশার ১৯৭৩ সালে ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশনের এক কর্মকর্তা ফ্রেড ক্রেমারের সাথে আলোচনা করে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্স উয়ে-কে একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে খেতাব রক্ষার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে চালু চব্বিশ রাউন্ডের ম্যাচ খেলতে তিনি রাজি নন। তিনটে নতুন প্রস্তাব দিলেন তিনি।

ববি ফিশারের মতে চব্বিশ রাউন্ডের ম্যাচে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে প্রথমে যিনি দুটো রাউন্ডের লিড পেয়ে যাবেন তিনি স্বাভাবিক কারণেই বাকি রাউন্ডগুলো ক্রমাগত ড্র করতে চাইবেন। ফলে প্রথমে পিছিয়ে পড়লে খেলায় ফিরে আসা প্রায় অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে ১৯৭২ সালে বরিস স্প্যাসকির বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে ১৪ থেকে ২০ রাউন্ড পর্যন্ত তাঁর নিজের টানা ড্র করার নজির তুলে ধরেন তিনি। তাই তিনি বলেন নির্দিষ্ট সংখ্যার রাউন্ডের পরিবর্তে ড্র বাদ দিয়ে প্রথম দশ রাউন্ড যিনি জিতবেন তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হোক। অর্থাৎ ম্যাচ জিতলে এক পয়েন্ট হিসাবে যিনি প্রথম ১০ পয়েন্ট পাবেন তিনি হবেন নতুন চ্যাম্পিয়ান।

দ্বিতীয়ত ম্যাচে রাউন্ডের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যাবে না।

তৃতীয়ত যদি কখনো দু পক্ষের পয়েন্ট সংখ্যা ৯-৯ হয়ে যায় তাহলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানই খেতাব ধরে রাখতে পারবেন। তবে সে ক্ষেত্রে প্রাইজ মানি দু’জনের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে।

১৯৭৪ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে ফ্রান্সের নিসে-তে চেস অলিম্পিয়াড চলাকালীন ববি ফিশারের প্রস্তাবিত নতুন ফরম্যাট নিয়ে আলোচলায় বসলেন ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা। অধিকাংশই ড্র বাদ দিয়ে প্রথমে ১০ রাউন্ড যিনি জিতে যাবেন তাঁকেই জয়ী ঘোষণা করার প্রস্তাব মেনে নিলেও বাকি দুটো মানলেন না। যুক্তি হিসাবে বলা হলো ফল ৯-৯ হওয়া পর্যন্ত খেলা গড়ালে বা রাউন্ডের সংখ্যা নির্দিষ্ট না করে দিলে অনন্তকাল ধরে ম্যাচ চলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে খেতাবি ম্যাচে রাউন্ডের সংখ্যা ২৪ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ করার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। ববি ফিশারকে গৃহীত প্রস্তাব জানিয়ে দিলো ফেডারেশন।

২৩-শে জুন ববি ফিশার ফেডারেশনের প্রেসিডেন্টকে টেলিগ্রাম করে জানালেন তিনি তার তিন দফা প্রস্তাবের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই আপোষ করতে রাজি নন। প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর খেতাব ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত।

বিশ্বের দাবা মহল কিন্তু ববি ফিশারের দাবি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কারণ, অনেকের মতে ড্র বাদ দিয়ে ৯-৯ পয়েন্টে বর্তমান চ্যাম্পিয়ানকেই জয়ী ধরে নিলে চ্যালেঞ্জারকে জিততে হলে অন্তত দুটো রাউন্ড লিডের ব্যবধান ধরে রাখতেই হবে। কার্যত যেটা যথেষ্ট কঠিন। আবার বেশ কয়েকজন বিশ্ববিখ্যাত দাবাড়ু ফিশারের প্রস্তাবকে সমর্থনও জানালেন।

ফিশারের অনড় মনোভাবের জন্যে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে নেদারল্যান্ডে বিভিন্ন দেশের চেস ফেডারেশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে আবার এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সেখানে ম্যাচে রাউন্ডের সংখ্যা নির্দিষ্ট না রাখার প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হলেও ৯-৯ পয়েন্টে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানকে জয়ী ধরে নেওয়ার দাবি নিয়ে ভোটাভুটি হলো। উপস্থিত ৬৭ জন প্রতিনিধির মধ্যে ববি ফিশারের প্রস্তাবের পক্ষে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩২ আর ৩৫-টা পড়লো বিপক্ষে। মাত্র তিন ভোটের ব্যবধানে ফিশারের দাবি নাকচ হয়ে গেলো। আলোচনায় গৃহীত প্রস্তাব জানানো হলো ববি ফিশার আর আনাতোলি কারপভকে। তাঁরা দু’জন এই প্রস্তাবে রাজি কিনা জানানোর জন্যে ডেড লাইন বেঁধে দেওয়া হলো ১-লা এপ্রিল। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কারপভ সম্মতি-পত্রে সই করে পাঠালেও ববি ফিশার লিখিত ভাবে কোনো উত্তর পাঠালেন না। ববি ফিশারের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় ওয়ার্ল্ড চেস ফেডারেশন ১৯৭৫ সালের তেসরা এপ্রিল আনাতোলি কারপভকে নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান হিসাবে ঘোষণা করে দিলো। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ছিল নিতান্তই একতরফা ও যথেষ্ট বিতর্কিত। কারণ, ববি ফিশারকে মুখোমুখি আলোচনায় বসার কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে তাঁর খেতাব বাজেয়াপ্ত করা হলো।

দাবার দুনিয়ায় প্রচণ্ড প্রতিভাধর খেলোয়াড় হিসাবে পরিচিতি থাকলেও আনাতোলি কারপভ কিন্তু চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচে একটা রাউন্ডও না খেলেই খেতাবের অধিকারী হয়ে যাওয়ায় তার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্নচিহ্ন ছিল। কারণ, তখনও পর্যন্ত বহু বিশেষজ্ঞের মতে তুলনামূলকভাবে ববি ফিশারের প্রতিভা ছিল বেশি। এর আগে আনাতোলি কারপভ কোনোদিনই ববি ফিশারের মুখোমুখি হননি। সেই কারণে ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে ইতালির মিলান শহরে একমাত্র ববি ফিশার বাদে পয়েন্টের হিসাবে সেই সময়কার বিশ্বের প্রায় সমস্ত শীর্ষ স্থানীয় চেস খেলোয়াড়কে নিয়ে আয়োজিত একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন কারপভ। সোভিয়েত রাশিয়ার চ্যাম্পিয়ান হিসাবে তাঁর তিনটে খেতাবের প্রথমটা আসে ১৯৭৬ সালে। এছাড়াও ১৯৭৫ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের স্বীকৃতি পাওয়া থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত, এর পরের দশ বছর পৃথিবীর নানা প্রান্তে আয়োজিত প্রায় সমস্ত স্বীকৃত টুর্নামেন্টে খেলে, প্রায় সমস্ত দেশের নামি খেলোয়াড়দের হারিয়েছিলেন তিনি। এই সময় সারা বিশ্ব জুড়ে পরপর ন’টা বড়ো প্রতিযোগিতা জিতে তিনি এক অনন্য নজির স্থাপন করার পর আনাতোলি কারপভের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সমালোচকদের মনে সংশয়ের কোনো অবকাশ রইলো না। কিন্তু ববি ফিশারের সাথে না খেলতে পারার আফসোস তাঁর রয়েই গেলো।

এদিকে বরিস স্প্যাসকির সামনে অযাচিত ভাবে চ্যালেঞ্জার হিসাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানের খেতাব জেতার আরেকটা সুযোগ চলে এলো। ১৯৭৭ সালের ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের নক আউট পর্বে আগের বারের রানার আপ ভিক্টর করশনয় আর ১৯৭৫ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ানের খেতাব হারানো ববি ফিশারকে সরাসরি অংশ গ্রহণ করার জন্যে আমন্ত্রণ পাঠালো বিশ্ব দাবা ফেডারেশন। কিন্তু ববি ফিশার অসম্মত হওয়ায় আগের টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালিস্ট হিসাবে বরিস স্প্যাসকি সুযোগ পেয়ে গেলেন। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনাল আর সেমিফাইনাল পর্বে সহজে জিতে গেলেও ১৯৭৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড শহরে অনুষ্ঠিত ফাইনালে হেরে গেলেন ভিক্টর করশনয়ের কাছে। ফলে নতুন চ্যালেঞ্জার হিসাবে উঠে এলেন ভিক্টর করশনয়। এরপর ১৯৭৮ সালে ফিলিপিন্সে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে সাতচল্লিশ বছর বয়সী করশনয় মুখোমুখি হলেন তাঁর থেকে কুড়ি বছরের ছোট আনাতোলি কারপভের। এইবারের ফাইনালে কিন্তু রাউন্ডের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হলো না। ঠিক হলো ড্র বাদ দিয়ে প্রথমে যে ছয় পয়েন্ট পাবে তাকেই জয়ী ঘোষণা করবে ফেডারেশন। শেষ পর্যন্ত এই ম্যারাথন ম্যাচে ৩২ রাউন্ডের মাথায় প্রথমে ছটা গেম জিতে খেতাব ধরে রাখতে সমর্থ হলেন কারপভ। করশনয় জিতেছিলেন পাঁচটা। একুশটা রাউন্ড ড্র হয়েছিল।

এরপর ১৯৮১ সালের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান্সকাপের ফাইনালেও ভিক্টর করশনয়কে হারিয়ে খেতাব ধরে রাখেন আনাতোলি কারপভ। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের মোট চব্বিশ রাউন্ডের ফাইনাল ম্যাচে আনাতোলি কারপভকে হারিয়ে মাত্র বাইশ বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ট চ্যাম্পিয়ান হিসাবে উঠে এলেন গ্যারি কাসপারভ।

গ্যারি কাসপারভ বনাম আনাতোলি কারপভ

এতো কাহিনী শোনানোর পিছনে একটাই কারন যে এই সময় ববি ফিশার কি করছিলেন আর কোথায় গেলেন ? কারণ, ১৯৭২ সালের পর তাঁকে কোনো টুর্নামেন্টেই অংশ নিতে দেখা যায়নি। বরং ১৯৭২ সালের আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিক শহরের সেই ঐতিহাসিক লড়াইয়ের পর দাবার দুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আনাতোলি কারপভ, ভিক্টর করশনয় আর গ্যারি কাসপারভের মতো রাশিয়ান গ্রান্ড মাস্টাররা। বরিস স্প্যাসকিও বেশ কিছুদিন সেই বৃত্তে ঘোরাফেরা করেছেন।

পরবর্তী পর্বের লিংক : শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (চতুর্থ পর্ব)

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।