সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (অষ্টম এবং শেষ পর্ব)

শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (অষ্টম এবং শেষ পর্ব)

আগস্ট ১২, ২০২০ ৯৪৫ 1

পূর্ববর্তী পর্বের লিংক : শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (সপ্তম পর্ব)

কারণটা ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত ববি ফিশারের অর্থ। পরিমাণটা নেহাত কম ছিল না। ১৪০ মিলিয়ান আইস্ল্যান্ডিক ক্রোনার। অর্থাৎ দু’ মিলিয়ান আমেরিকান ডলারের বেশি। তাই তিনি মারা যাওয়ার পরেই তাঁর সেই সম্পত্তির স্বত্ব নিয়ে টানাপোড়েন আরম্ভ হতে বেশি সময় লাগলো না। প্রথমে মার্কিন সরকার আইসল্যান্ডের অর্থ মন্ত্রকের কাছে সুদ সমেত ফিশারের বকেয়া ট্যাক্স আদায় করার জন্যে দাবী করে বসলো। এদিকে আমেরিকা থেকে ববি ফিশারের প্রয়াত দিদি জোয়ানের স্বামী রাসেল টার্গ তার দুই ছেলে আলেক্সজান্ডার আর নিকোলাসকে নিয়ে হাজির হলেন রেইকিয়াভিকে। রক্তের সম্পর্কে জীবিত আত্মীয় হিসাবে তাঁরাও ববি ফিশারের সঞ্চিত অর্থের উপর নিজেদের দাবী জানালেন। সমস্ত ব্যাপারটাই জাপানে বসে শুনলেন মিয়কো ওয়াতাই। টোকিও থেকে সোজা রেইকিয়াভিক শহরে চলে এলেন তিনি। আইসল্যান্ডের পার্লামেন্টে আইনজীবী মারফত চিঠি দিয়ে জানালেন ববি ফিশারের বৈধ স্ত্রী হিসাবে তার মৃত স্বামীর একমাত্র উত্তরাধিকারী তিনি। প্রমাণ হিসাবে দাখিল করলেন জাপানের উশিকু ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকাকালীন ববি ফিশারের সাথে ২০০৫ সালের ১১-ই মার্চ তারিখের ম্যারেজ সার্টিফিকেট। মামলা গড়ালো  রেইকিয়াভিক ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। রাসেল টার্গের আইনজীবী আদালতে মিয়কোর দাবী চ্যালেঞ্জ করে বললেন, যেহেতু সেই সময়ে জাপানে ববি ফিশারের কোনো বৈধ পাসপোর্ট ছিল না তাই সেই ম্যারেজ সার্টিফিকেটের আইনগত কোনো মূল্য নেই। এরই মধ্যে আবার হঠাৎ ফিলিপিন্স থেকে মেরিলিন ইয়াং নামে এক মহিলা তার কন্যাকে নিয়ে হাজির হলেন আইসল্যান্ডে। তিনি জানালেন ২০০০ সালে ফিলিপিন্সে থাকার সময় ববি ফিশার নাকি বিয়ে করেছিলেন তাঁকে। যদিও সেই সংক্রান্ত কোনো প্রামাণ্য কাগজপত্র তিনি দেখতে পারলেন না, তবে জানালেন তাঁর কন্যা জিঙ্কি ইয়াং-এর জন্মদাতা পিতা হলেন ববি ফিশার। প্রমাণ হিসাবে তিনি কিছু পুরোনো ফটোগ্রাফ আর ২০০৭ সালের ৪-ঠা ডিসেম্বর তারিখে জিঙ্কির ব্যাংক একাউন্টে স্কুলের ফিস হিসাবে ববি ফিশারের পাঠানো একটা সামান্য অংকের ব্যাংক রেমিট্যান্সের রশিদ দাখিল করলেন আদালতে। সাথে ফিশারের কাছে জিঙ্কির পাঠানো একটা ফটো পোস্টকার্ডও কোর্টে পেশ করলেন মেরিলিনের আইনজীবী। সেখানে ববি ফিশারকে ‘ড্যাডি’ বলে সম্বোধন করেছে জিঙ্কি। মামলা ক্রমশ দীর্ঘায়িত হতে লাগলো। সমস্যাও ছিল যথেষ্ট জটিল। ম্যাগনাস স্কুলাসন ছিলেন রেইকিয়াভিকের খুব নামকরা একজন মনোবিদ। জীবনের শেষ বছরগুলোয় ববি ফিশার প্রায়ই যেতেন তাঁর কাছে। ধীরে ধীরে ফিশারের আস্থা অর্জন করেছিলেন তিনি। মনের সব কথাই তাঁর কাছে খুলে বলেছিলেন ফিশার। কোর্টে সাক্ষী দিতে গিয়ে সেই ম্যাগনাস স্কুলাসন খুব জোরের সাথে বললেন মেরিলিন ইয়াং মিথ্যা কথা বলছেন। ববি ফিশার কোনোদিনই তাঁকে বিয়ে করেননি। জিঙ্কি ইয়াং কখনই ফিশারের সন্তান হতে পারে না। জেলা আদালত কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারায় মামলা স্থানান্তরিত হলো আইসল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্টে।

আইনজীবীদের দীর্ঘ বাদানুবাদের পর আর কোনো উপায় না দেখে জিঙ্কি ইয়াং-এর ডিএনএ ম্যাচিং করার  জন্যে ২০১০ সালের ১৬-ই জুন ববি ফিশারের মরদেহ সমাধি খুঁড়ে কফিন থেকে বার করার অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। অবশেষে সেই বছরের অর্থাৎ ২০১০ সালের ৫-ই জুলাই সোমবার একজন ডাক্তার, একজন পাদ্রী আর ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের একজন সরকারি আধিকারিকের উপস্থিতিতে সমাধি থেকে বার করে ফেলা হলো ববি ফিশারের প্রায় আড়াই বছরের পুরোনো মৃতদেহ। প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করার পর সসম্মানে পুনরায় আবার সমাধিস্থ হলেন ববি ফিশার।

২০১০ সালের ১৭-ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে জমা পড়লো ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট। ফলাফল দেখে বিচারপতিরা বুঝলেন মেরিলিন ইয়াং কোর্টে মিথ্যা কথা বলেছেন। জিঙ্কি ইয়াং কোনোভাবেই ববি ফিশারের মেয়ে নয়। দুজনের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট মেলেনি। আদালতে মিথ্যা হলফনামা জমা দেওয়ার জন্যে মেরিলিনকে সামান্য জরিমানা করে ববি ফিশারের সম্পত্তির উপর তাঁদের দাবী নাকচ করে দিলো সুপ্রিম কোর্ট। এবার বাকি রইলো একদিকে সপুত্র রাসেল টার্গ আর অন্যদিকে মিয়কো ওয়াতাই।

দীর্ঘ বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ৩-রা মার্চ মিয়কো ওয়াতাই আর ববি ফিশারের ম্যারেজ সার্টিফিকেট আইনত বৈধ বলে রায় দিলো আইসল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট। ফলে ফিশারের সম্পত্তির উপর শুধুমাত্র মিয়কো ওয়াতাই-এর দাবী সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। মিথ্যা মামলা করার অপরাধে জরিমানা হিসাবে কোর্টের আদেশে টার্গ পরিবার ৫৭০০০ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হলো মিয়কো ওয়াতাইকে। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় অনুযায়ী মার্কিন অর্থ দফতরকে ববি ফিশারের কাছ থেকে পাওনা বকেয়া ট্যাক্স মিটিয়ে ভালো অংকের অর্থ পেয়ে টোকিও ফিরে গেলেন তিনি।

এই মুহূর্তে ৭৫ বছর বয়সী মিয়কো ওয়াতাই টোকিওতে তার এপার্টমেন্টে একা থাকেন। এখনো যথেষ্ট কর্মক্ষম তিনি। সাংবাদিক আর পরিচিতদের কাছে ববি ফিশার সম্পর্কে আলোচনায় তিনি অক্লান্ত। সারা বাড়ি জুড়ে তিনি সাজিয়ে রেখেছেন প্রয়াত স্বামীর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত অসংখ্য লেখার কাটিং সহ প্রচুর দুষ্প্রাপ্য স্মারক।

১৯৭৮ সালে খানিকটা বাধ্য হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে ফ্রান্সে চলে এলেও বরিস স্প্যাসকির রাশিয়া আর ফ্রান্স দুই দেশেরই যুগ্ম নাগরিকত্ব ছিল। আদতে কম্যুনিস্ট দেশের মানুষ বলে ফ্রান্সে বরিস স্প্যাসকি কোনোদিনই খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। তাঁর পরিবারের উপর নজর থাকতো ফরাসি গোয়েন্দাদের। নানা ঘটনায় বরিস স্প্যাসকির মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা গড়ে উঠেছিল তাকে প্রাণে মেরে ফেলার একটা চক্রান্ত চলছে। সবসময়ই তিনি প্রাণভয়ে ভীত থাকতেন। ২০০৬ সালের ১-লা অক্টোবর সানফ্রান্সিসকোতে আয়োজিত এক সেমিনারে দাবার উপর বক্তৃতা দেওয়ার সময় স্প্যাসকি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। খানিকটা সুস্থ হয়ে তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন। ২০১০ সালের ২৩-শে সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বার মারাত্মক স্ট্রোকের কবলে পড়েন স্প্যাসকি। সেই সময় পরিবার নিয়ে তিনি প্যারিসে থাকতেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও বরিস স্প্যাসকির শরীরের বাঁ দিক সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়ে। প্যারিসেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। যদিও ঠিক মতো চিকিৎসা হচ্ছে কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তাঁর মনে। চিকিৎসা চলাকালীন তাঁর বাড়ির টেলিফোন লাইন, ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ নজরবন্দী করে রাখা হয় তাঁকে। সুযোগ বুঝে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কোনোরকমে তিনি কয়েকজন বন্ধুর সাহায্যে ফ্রান্সে রাশিয়ান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত ব্যাপারটা জানান। অবশেষে তাদের ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালের ১৬-ই আগস্ট তিনি একাই ফ্রান্স ছেড়ে মস্কোয় চলে আসেন। তিরাশি বছর বয়সী বরিস স্প্যাসকি এখন মস্কো শহরের উপকণ্ঠে একটা ছোট এপার্টমেন্টে একা থাকেন। হুইল চেয়ারের উপর নির্ভরশীল হলেও এমনিতে তিনি অনেকটাই সুস্থ। বাড়ি থেকে খুব প্রয়োজন ছাড়া বেরোন না। টেলিফোনে পরিচিতদের সাথে কথা বলেন। যোগাযোগ রাখেন প্যারিস নিবাসী পরিবারের সাথেও। ‘মাই চেস পাথ’ নামে একটা আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন তিনি। দাবার দুনিয়ায় সর্বকালের সেরা প্রতিভাদের অন্যতম হলেন বরিস স্প্যাসকি। ২০১০ সালের ২৭-শে মার্চ ভ্যাসিলি সিমিস্লভের মৃত্যুর পর এই মুহূর্তে তিনিই হলেন পৃথিবীর সবচাইতে বর্ষীয়ান জীবিত প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ান। তবে ববি ফিশারের ভূত তাঁকে আজও স্বপ্নে তাঁকে তাড়া করে কিনা সেটা অবশ্য জানা যায়নি।

৯২ বছর বয়সী বরিস স্প্যাসকি

একটা প্রশ্ন কিন্তু অমীমাংসিত রয়ে গেলো। ১৯৭৫ সালের খেতাবি লড়াইতে ববি ফিশার যদি মুখোমুখি হতেন আনাতোলি কারপভের তাহলে ফলাফল কি হতে পারতো। সকলের দুর্ভাগ্য এই ঘটনাটা ঘটেনি। এর পিছনে একটা কারণ আছে। ব্যাপারটা কিছুটা আইকিউ সংক্রান্ত। কম্পিউটার জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মানুষদের নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে বুদ্ধিমত্তা মাপার চেষ্টা করা হয়েছে। সংক্ষেপে বাংলায় আমরা যাকে বুদ্ধাঙ্ক বলি। ইংরেজিতে আইকিউ। পৃথিবীর বহু স্বীকৃত সংস্থাই স্বাধীন ভাবে এই রেটিং দিয়ে থাকে। ষোলো বছর বয়সে হাইস্কুলে পড়ার সময় বিভিন্ন বিষয়ে অনেক কৃতি ছাত্রদের সাথে ববি ফিশারেরও আইকিউ টেস্ট করেছিল স্ট্যানফোর্ড-বিনেট নাম বিখ্যাত এক সংস্থা। তাঁদের রেটিংয়ে ববি ফিশারের গড় আইকিউ ছিল ১৮০ যা কিনা আলবার্ট আইনস্টাইনের থেকেও খানিকটা বেশি। কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব সত্যি। কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকলে নেটে মিলিয়ে নিতে পারেন। আবার অন্যদিকে আনাতোলি কারপভের প্রতিভাও ছিল সর্বজন স্বীকৃত। তাই ববি ফিশার আর আনাতোলি কারপভের মধ্যে ১৯৭৫ সালে কে বাজিমাত করতেন এই প্রশ্নটা চিরকাল ভাবিয়ে চলেছে তামাম বিশ্বের দাবাপ্রেমী মানুষদের। বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। নিজেদের মতো করে বিশ্লেষণ করেছেন সবাই। সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে নিজেদের মতো করে যুক্তি সাজিয়েছেন। এই বিতর্ক কিন্তু আজও চলছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমস্তটা আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু সংক্ষেপে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।

যেমন ধরুন বরিস স্প্যাসকি। তিনি ববি ফিশারের থেকেও আনাতোলি কারপভকে বেশি কঠিন প্রতিপক্ষ বলে মনে করেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ববি ফিশারের প্রস্তাবিত ফরম্যাটে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ শেষ পর্যন্ত যদি সত্যিই খেলা হতো সেক্ষেত্রে গ্যারি কাসপারভের মতো বরিস স্প্যাসকিও বলেছিলেন ১০-৬ পয়েন্টে হেরে যেতেন আনাতোলি কারপভ। এমনকি ১৯৭৮ সালের খেতাব রক্ষার যুদ্ধে আনাতোলি কারপভের সাথে ববি ফিশারের মুখোমুখি হওয়ার আরেকটা সম্ভাবনা ছিল। সেক্ষেত্রেও বরিস স্প্যাসকি ছাড়াও বহু বিখ্যাত দাবা বিশেষজ্ঞদের মতে ফলাফল একই হতো।

এই স্পেকুলেশনগুলোর পক্ষে বহু যুক্তি দেখিয়েছেন সবাই। কয়েকটা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত পয়েন্টের হিসাবে ফিডের রাঙ্কিং পদ্ধতি। ১৯৭১-৭২ সালে ববি ফিশারের সর্বোচ্চ পয়েন্ট যেখানে ২৭৮০ সেখানে আনাতোলি কারপভের ক্ষেত্রে ১৯৭৪-৭৫ সালে সেটা ২৭০৫ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছিল। এই ৭৫ পয়েন্টের ব্যবধানটা দাবার ক্ষেত্রে কিন্তু একটা বড়ো ফ্যাক্টর।

বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার তিরিশ বছর বয়সের আশেপাশে কৃতিত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিচরণ করে থাকেন। ১৯৭৫ সালে ববি ফিশারের বয়স ছিল ৩২ আর আনাতোলি কারপভের ২৪ বছর।

এবার খেয়াল করে দেখুন আনাতোলি কারপভ বনাম গ্যারি কাসপারভের ১৯৮৪ সালের ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচের ঘটনা। ১৯৭৫ সালে ববি ফিশারের প্রস্তাবিত ফরম্যাট না মানলেও ১৯৮৪ সালের সেই ম্যাচে কিন্তু অনেকটা সেই ফর্মুলাতেই ফিডে ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে। অর্থাৎ সেখানে রাউন্ডের সংখ্যা নির্দিষ্ট রাখা হলো না। ড্র রাউন্ডগুলো বাদ দেওয়া হলো। তবে পার্থক্যও ছিল। দশের পরিবর্তে প্রথম ছটা রাউন্ড যিনি জিতবেন তাঁকেই সরাসরি জয়ী ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম আর নবম রাউন্ডে জিতে কারপভের জয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় চার। কাসপারভের তখন শূন্য। নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ছটা রাউন্ড যিনি জিতবেন তাঁকেই বিজয়ী বলে মেনে নেওয়া হবে। সবাই ধরে নিয়েছিলেন খুব বেশি হলে ১৮ রাউন্ডেই ৬-০ স্কোরে হোয়াইট ওয়াশ হয়ে যাবেন গ্যারি কাসপারভ। এরপর ১০ থেকে ২৬ নম্বর রাউন্ড পর্যন্ত খেলা ড্র হয়। ২৭ নম্বর রাউন্ড কোনোরকমে যেতেন কারপভ। কিন্তু এরপরেই ঘুরে দাঁড়ান গ্যারি কাসপারভ। ৩২, ৪৭ আর ৪৮ নম্বর রাউন্ড জিতে যান তিনি। মাঝের সব কটা রাউন্ডই ড্র হয়ে যায়। অর্থাৎ ৪৮ রাউন্ডের শেষে স্কোর দাঁড়ায় আনাতোলি কারপভ পাঁচ আর গ্যারি কাসপারভ তিন। ম্যাচ ততক্ষণে গড়িয়েছে ছয় মাসের কাছাকাছি। আনাতোলি কারপভ ছিলেন শীর্ণকায় ছোটোখাটো মানুষ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো দীর্ঘ সময় ধরে এই ম্যাচের ধকল নেওয়ার মতো শারীরিক স্ট্যামিনার ঘাটতি আছে তাঁর। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘসূত্রিতার কারণ দেখিয়ে নজিরবিহীন ভাবে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের সেই ম্যাচ অমীমাংসিত ঘোষণা করে ফিডে।

এবার আসি ১৯৭৫ সালের ববি ফিশার বনাম আনাতোলি কারপভের প্রসঙ্গে। ছয় ফিট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ববি ফিশার ছিলেন সুঠাম বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন তিনি। তথ্য বলছে সেই সময় আনাতোলি কারপভের ওজন ছিল মাত্র ৪৮ কেজি। সেই ম্যাচে আবার প্রথম ১০-টা রাউন্ড যিনি জিতবেন তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করার কথা। অর্থাৎ দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে খেলা চলার সম্ভাবনার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যেত না। এতটা শারীরিক ধকল নেওয়ার মতো ক্ষমতা কারপভের ছিল না। তাই পরের দিকে খেলার উপর সেই প্রভাব ছিল অবশ্যম্ভাবী।  তাই খুব পরিষ্কার ভাবে বলা যায় ফিশারের প্রস্তাবিত অনির্দিষ্ট রাউন্ডের সেই ম্যাচে ববি ফিশারের জেতার সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু ফিশারের অনুকূলে ১০-৪ স্কোর সবাই অনুমান করলেন কীভাবে ? অর্থাৎ আনাতোলি কারপভ অন্তত চারটে রাউন্ড জিতে যেতেন। এর উত্তর লুকিয়ে আছে ববি ফিশারের খেলার স্টাইলে। কালো ঘুঁটি নিয়ে খেললে বেশির ভাগ গ্র্যান্ডমাস্টার সাধারণত ডিফেন্সিভ খেলে থাকেন। কারণ, সাদা নিয়ে প্রথম চাল যিনি দেবেন সাধারণত তিনিই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকেন। কিন্তু ববি ফিশার কালো নিয়ে খেললেও রক্ষণাত্মক খেলার পরিবর্তে সোজা প্রতি-আক্রমনণ চলে যেতেন। এছাড়াও যেখানে গেমের আর কোনো ফলাফলের সম্ভাবনা না দেখে প্রতিপক্ষের ড্র-এর প্রস্তাব অন্যেরা স্বচ্ছন্দে মেনে নিতেন সেখানে ববি ফিশার সহজে খেলা ফলশূন্য না মেনে আক্রমণ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। এই অনমনীয় মনোভাবের জন্যে ফিশারকে প্রচুর খেসারত দিতে হয়েছে। অনেক গেম হেলায় হেরেছেন তিনি। তাই আনাতোলি কারপভের ক্ষেত্রে অন্তত চারটে রাউন্ড জেতার সম্ভাবনা ছিল।

এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। ২০০২ সালে ‘ফিলাডেলফিয়া ইনকোয়ারার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের দাবী অনুযায়ী হ্যান্স গেরহার্ড ফিশার কোনোদিনই ববি ফিশারের জন্মদাতা পিতা ছিলেন না। পিটার নিকোলাস এবং ক্লেয়া বেনসন নামে ওই পত্রিকার দুই সাংবাদিক কিছু নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন পল নিমেনেই নামে হাঙ্গেরিয়ান এক অংকশাস্ত্রবিদ ছিলেন ববি ফিশারের আসল পিতা। এদিকে ববি ফিশারের স্কুল সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট সমেত সমস্ত কাগজপত্রে পিতা হিসাবে গেরহার্ড ফিশারের নামই উল্লেখ করা ছিল। ববি ফিশার নিজেও সব জায়গায় নিজেকে হ্যান্স গেরহার্ড ফিশারের সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রকৃত সত্যটা কি ?  জিটা রাজ্যাক্স্যানি এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন ১৯৯২ সালে তিনি প্রথম যখন লস এঞ্জেলস যান তখন ববি ফিশার তাঁর ছেলেবেলার প্রসঙ্গে একবার পল নিমেনেই সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। ব্রুকলিনে ১০৫৯, ইউনিয়ন স্ট্রিটের ঠিকানায় তাঁদের ছোট্ট এপার্টমেন্টে পল নিমেনেইকে কয়েকবার দেখেছিলেন ফিশার। মাঝে মাঝে ববি ফিশারকে বাইরে ঘোরাতে নিয়ে যেতেন তিনি। ব্যাস এইটুকুই। এর বেশি কিছু আর ববি ফিশারের মনে ছিল না। কিন্তু আমেরিকায় ববি ফিশারের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে একটা কানাঘুঁসো বরাবরই ছিল। কারণ, ১৯৩৯ সালে রেজিনা ফিশার মেয়েকে নিয়ে মস্কো ছেড়ে শিকাগো আসার পর গেরহার্ড ফিশার কোনোদিনই আমেরিকা আসেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের সন্দেহ ছিল কম্যুনিস্টদের প্রতি গেরহার্ড ফিশার যথেষ্ঠ সহানুভূতিশীল। তাই তাদের নজর এড়িয়ে গেরহার্ড ফিশারের পক্ষে আমেরিকায় পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ারকোনো সুযোগই ছিল না। এদিকে ববি ফিশার জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের ৯-ই মার্চ তারিখে। তাঁর মানে রহস্য কিছু ছিলই। স্বাভাবিক কারণেই আজন্ম ববি ফিশারকে এই প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে।

কিন্তু আসল ঘটনাটা খুব সম্ভব অন্যরকম ছিল। জুলিও বেকেরা রিভেরো নামে এক আমেরিকান গ্র্যান্ডমাস্টার ২০১১ সালের আগস্ট মাসে ববি ফিশার সম্পর্কে ‘হি লার্নড ডাইরেক্টলি ফ্রম গড’ নামে একটা বই লেখেন। রিভেরোর জন্ম কিউবাতে হলেও বহুদিন ধরে উনি ফ্লোরিডায় থাকেন। সেখানে তিনি পুরোনো পেপার কাটিং খুঁজে বার করে দেখিয়েছেন আমেরিকায় না এলেও ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি হ্যান্স গেরহার্ড ফিশার মেক্সিকো গিয়েছিলেন। সেখানে ওনার অসুস্থতার খবর পেয়ে সেই বছরের জুন মাসে রেজিনা ফিশার মেক্সিকো যান। মাস দুয়েক মতো সেখানে স্বামীর সাথে ছিলেন তিনি। এখানেই থামেননি জুলিও রিভেরো। এর অনেক পরে এক সংবাদ প্রতিনিধির সাথে রেজিনা ফিশারের সাক্ষাৎকারের নথি তুলে এনেছেন তিনি। সেখানে রেজিনা বলেছেন যে মেক্সিকোয় গেরহার্ড ফিশারের সাথে থাকার সময়ই ববি ফিশারের গর্ভ ধারণ করেন তিনি। ১৯৪৫ সালের ১৪-ই সেপ্টেম্বর গেরহার্ড ফিশারের সাথে তাঁর ডিভোর্স হওয়ার সময় ববি ফিশারের বয়স ছিল দুবছর।

কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটাই হলো অনুমান সাপেক্ষ। রেজিনা ফিশারের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো খুব দুরূহ ব্যাপার। নিজের পিতা সম্পর্কে একবারই মাত্র জীবনের প্রথমদিকে ববি ফিশার এক সংবাদপত্রের প্রতিনিধির কাছে খুব সংক্ষিপ্ত একটা বয়ান দিয়েছিলেন। “আমার মাত্র দুবছর বয়সে মাকে ছেড়ে চলে যান বাবা। আমি তাঁকে কোনোদিন চোখে দেখিনি। আমি মায়ের কাছে শুনেছি তাঁর নাম ছিল হ্যান্স গেরহার্ড আর তিনি জার্মান ছিলেন।”

প্রশ্ন অনেক আছে। হ্যান্স গেরহার্ড ফিশার ১৯৯৩ সালের ২৫-শে ফেব্রুয়ারি বার্লিনে মারা গেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে ববি ফিশারের সাথে হ্যান্স গেরহার্ডের কোনোদিন দেখা হয়েছিল কিনা সেই নিয়ে কোথাও কোনো তথ্য নেই। কিন্তু নিজের সঠিক পিতৃপরিচয় নিয়ে খুব ছোটবেলা থেকেই ববি ফিশারের মনে অবশ্যই দ্বন্দ্ব ছিল। এই সংশয় তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে সারা জীবন। খুব সম্ভব এই অবাঞ্ছিত প্রশ্নের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেই তিনি একক জীবন বেছে নিয়েছিলেন।  পারতপক্ষে লোকজন এড়িয়ে চলতেন ।  এডলফ হিটলারের নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন ছিল। ‘মাইন কাম্ফ’ লেখার সময় তিনি ইহুদিদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিজের মতো করে সাজিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু হিটলারের ভক্ত ছিলেন বলেই সারা জীবন ববি ফিশার ইহুদি বিরোধী বক্তব্য রেখে গেছেন এ কথা মেনে নেওয়া সত্যিই মুশকিল। প্রথম জীবনে জার্মানির থার্ড রাইখ নিয়ে প্রচণ্ড উৎসাহ থাকলেও পরের দিকে বিভিন্ন দেশের ইতিহাস নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলেন ববি ফিশার। ১৯৫২ সালের ১-লা মার্চ ওয়াশিংটন ডিসি-তে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে মারা যান পল নিমেনেই। হাঙ্গেরিয়ান হলেও পল নিমেনেই ছিলেন ইহুদি বংশজাত। খুব জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা । এখানেই কি লুকিয়ে আছে ববি ফিশারের আজন্ম ইহুদি বিদ্বেষের রহস্য ? প্রশ্নটা ভাবিয়েছে ববি ফিশারের জীবনীকারদের।

ববি ফিশারকে নিয়ে আমেরিকা ছাড়াও ইউরোপের অনেক দেশে অনেক প্রামাণ্যছায়াছবি তৈরি হয়েছে। বই লেখা হয়েছে অসংখ্য। ডকুমেন্টারি ফিল্মের সংখ্যাও প্রচুর। ১৯৯৩ সালে হলিউডে মুক্তি পেয়েছিলো ‘সার্চিং ফর ববি ফিশার’ ছবিটা। কিন্তু সেই সময় ববি ফিশারের উপর মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে হল থেকে সিনেমাটা তুলে নেওয়া হলেও পরে টাইটেল পাল্টে ‘ইনোসেন্ট মুভস’ নাম দিয়ে ইংল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটা দেশে প্রদর্শিত হয় সেই ছবি। ফিশারের মৃত্যুর পর ‘ববি ফিশার লাইভ’ (২০০৯), ‘রিক্যুইম ফর ববি ফিশার (২০১০), ‘ববি ফিশার এগেনস্ট দ্য ওয়ার্ল্ড’ (২০১১) ছাড়াও ২০১৪ সালে হলিউডে তার জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুক্তি পায় ‘পন স্যাক্রিফাইস’ । অত্যন্ত উচ্চ প্রশংসিত এই ছবিতে ববি ফিশারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্পাইডারম্যান ট্রিলজিখ্যাত অভিনেতা টবি ম্যাগুইয়ার । ববি ফিশারের শেষ কয়েকটা বছরের স্মৃতি নিয়ে ২০০৯ সালে আইসল্যান্ডে তৈরী হয়েছে ‘মি এন্ড ববি ফিশার’ সিনেমাটা।

২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পন স্যাক্রিফাইস’ ছবির পোস্টার

লেখাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে গেছে। শুধু ছোট্ট একটা কাহিনী বলে শেষ করবো। রেইকিয়াভিক শহরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গল্পটা নিজের মুখেই শুনিয়েছিলেন ববি ফিশার। জাপানে উশিকু ডিটেনশন সেন্টারে বেশ কয়েক মাস বন্দী থাকাকালীন অবস্থায় সময় কাটানোর জন্যে একজন বার্মিজ প্রহরীর সাথে কয়েক রাউন্ড চেস খেলেছিলেন ফিশার। সে বেচারি ববি ফিশারের নামটা কোনোদিন শোনেনি। তবে দাবা খেলার প্রাথমিক জ্ঞানটুকু ছিল তার। একটা রাউন্ড নাকি ড্র হয়েছিল। তবে ববি ফিশার সেই প্রহরীর নামটা আর মনে রাখতে পারেননি। ঘটনাটা খুব বেশি দিন আগের ব্যাপার না। ধরে নেওয়া যেতে পারে সেই ভদ্রলোক এখনো সুস্থ শরীরে জীবিত আছেন। ইতিহাস তাকে মনে রাখেনি। তবে ববি ফিশারের বলা কাহিনী যদি সত্যি হয় তবে সম্ভবত তিনিই হলেন পৃথিবীর শেষতম ব্যক্তি যিনি নিজের অজান্তেই দাবার জগতে সর্বকালের সেরা জিনিয়াসকে অন্তত একবার রুখে দিতে পেরেছিলেন।

(সমাপ্ত)

ছবি নেটের সৌজন্যে

তথ্যসূত্র :

https://www.chessgames.com/perl/chess.pl?tid=54397

http://billwall.phpwebhosting.com/articles/prize.htm

https://roar.media/bangla/main/biography/bobby-fischer/

https://www.chessgames.com/perl/chess.pl?tid=80204

https://en.chessbase.com/post/fischer-released-in-japan

https://www.telegraph.co.uk/news/features/3635401/Bobby-Fischers-final-bizarre-act.html

https://www.reuters.com/article/us-chess-fischer/chess-legend-bobby-fischer-dies-in-iceland-idUSL1870892220080118

https://www.theguardian.com/world/2008/jan/19/chess.sport

http://tartajubow.blogspot.com/2018/01/zita-rajcsanyi-bobby-fischers-girlfriend.html

https://en.chessbase.com/post/fischer-to-bush-and-koizumi-you-are-going-to-pay-for-this-

http://www.uschess.org/content/view/8124/319/

https://www.chess.com/article/view/he-learned-directly-from-god

মন্তব্য তালিকা - “শতাব্দীর সেরা দ্বৈরথ (অষ্টম এবং শেষ পর্ব)”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।