সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

গুটিবসন্তের টিকা – ভারতীয় ভেরিলেশন ও জেনারের ভ্যাক্সিন (তৃতীয় অধ্যায়)

গুটিবসন্তের টিকা – ভারতীয় ভেরিলেশন ও জেনারের ভ্যাক্সিন (তৃতীয় অধ্যায়)

আগস্ট ১১, ২০২০ ১০৬৮ 0

পূর্ববর্তী অধ্যায়ের লিংক: গুটিবসন্তের টিকা – ভারতীয় ভেরিলেশন ও জেনারের ভ্যাক্সিন (দ্বিতীয় অধ্যায়)

থারম্ভ

সাম্প্রতিক খবরের কাগজ পড়লে দেখা যাবে ইউরোপ আর আমেরিকা থেকে নতুন ওষুধ, নতুন পদ্ধতিতে করোনা টেস্টিং আর নতুন টিকা আবিষ্কারের দাবি সবথেকে বেশি উঠছে, চীন পিছিয়ে নেই। আর আমাদের দেশ থেকে পুরনো ওষুধ, যেমন ক্লোরোকুইন, এজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি বা বিসিজি টিকা করোনা-তে কার্যকর, দিয়ে করোনা আটকায়, এইসব প্রমাণ করা পরীক্ষা ও সমীক্ষা প্রকাশিত হচ্ছে। গঙ্গাজল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি মন্ত্রক পরীক্ষা করতে বলেছিলেন, আমাদের উচ্চতম মেডিক্যাল গবেষণা কেন্দ্র (ICMR) সেটা নাকচ করেছেন।

আমাদের গবেষণার প্রবণতা অবাক হবার মতো ব্যাপার নয়। এক-একটা দেশের, এক-একটা ঐতিহাসিক পর্যায়ে, বিজ্ঞান নিয়ে এক-একরকম কাজ করা সুবিধাজনক হয়। অতীতেও তাই ছিল। তাই একটা পর্যায়ে ভারতে ভ্যারিওলেশন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল, আর তারপরে জেনারের ভ্যাক্সিনের মতো বেশি নিরাপদ টিকা আবিষ্কারের কাজটা হয়েছিল পশ্চিম ইউরোপে। কিন্তু ভ্যাক্সিন চালু হবার পরে শিক্ষিত ভারতীয়দের একটা অংশ আমাদের প্রাচীন ভ্যারিওলেশন-এর ইতিহাসকেই ভুলতে বা অস্বীকার করতে চেয়েছে। সেটা খুব স্বাভাবিক নয়—হয়তো সেটা আমাদের হীনমন্যতারই নিদর্শন।

ইতিহাস ভোলার সাম্প্রতিক নিদর্শন

বাংলাভাষায় লেখা চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক আকরগ্রন্থ, সমরেন্দ্রনাথ সেনের লেখা “বিজ্ঞানের ইতিহাস” ১৯৫৫ সালে প্রকাশ পায়। তাতে ভারতীয় ভ্যারিওলেশন পদ্ধতির বিবরণ ছিল। প্রায় সমসাময়িক আকরগ্রন্থ জে ডি বার্নালের লেখা ‘Science in History” (প্রথম প্রকাশ ১৯৫৪ সাল) বইটিতে সামান্য হলেও ভ্যারিওলেশনের উল্লেখ আছে। কিন্তু তারপরে ইতিহাসচর্চাতেও ভারতীয় বা চীনা টিকাকরণ স্রেফ ‘নেই’ হয়ে গেল।

বাংলা ১৪০২ সনে একটি বই রবীন্দ্র পুরষ্কার পায়। বইটির নাম “চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস”, লেখক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, প্রকাশক প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন প্রাঃ লিঃ, প্রথম প্রকাশ– ১৯৯৪ সাল। প্রায় চার’শ পাতার এই বইতে গুটি বসন্ত নিয়ে লেখা হয়েছে যে ভারতে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এই রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কলমী শাকের রস এবং বাসক পাতা সেবন করার আর রুদ্রাক্ষ ধারণ করার বিধান ছিল। জেনারের টিকা নিয়ে লেখা আছে, অথচ ভারতীয় ভ্যারিওলেশন সম্পর্কে কোনো উল্লেখ নেই। মনে রাখতে হবে এটা কোনো ব্যতিক্রম নয়। ভারতের এই টিকা সম্পর্কে জানেন এমন লোক এখন খুব কম, যদিও বিংশ শতকের গোড়াতেও ভ্যারিওলেশন বাংলা থেকে পুরো বিলুপ্ত হয়নি।

প্রায় একই শিরোনামের আরেকটি বই। বইটির নাম “চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস, উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব”, লেখক বিনয়ভূষণ রায়, প্রকাশক সাহিত্যলোক, প্রথম প্রকাশ- ২০০৫ সাল। চার’শ পাতারও বেশি এই বইতে গুটিবসন্ত নিয়ে অল্পই লেখা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৫০ সালে বসন্তরোগ নিয়ে কলকাতায় যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন, তার একজন সদস্য ছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। তাঁর বক্তব্য এই বইয়ের ৪০৫ ও ৪০৬ পৃষ্ঠাতে তুলে ধরা হয়েছে। মধুসূদন গুপ্ত বলেছেন (বঙ্গানুবাদ বিনয়ভূষণ রায়ের)—

“ব্যক্তিবিশেষকে বাংলা টিকা দেওয়া বিপজ্জনক। এর দ্বারা একই পরিবারভুক্ত অন্য কেউ আক্রান্ত হতে পারে। কারণ, যে সমস্ত শিশুদের টিকা দেওয়া হয়নি, তাদেরই টিকা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলা টিকা নেবার জন্য যে সমস্ত প্রতিবেশী ইংরেজি টিকা নেয়নি তাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে ক্ষতিকারক হতে পারে। বাংলা টিকার জন্য অনেকেরই মৃত্যু ঘটে।… হিন্দুস্থানি জনসাধারণ দেবী শীতলার অন্ধভক্ত। … বিশ্বনাথ মালী নামে একজন দেশীয় ব্যক্তি (টিকাকর্মী) এই সমস্ত হিন্দুস্থানি ব্যক্তিদের টিকা দিয়ে ১৮৫০ সালে ১২,০০০ টাকা রোজগার করেছিল।”

চিত্র ৬ – মধুসূদন গুপ্ত (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)

দেশীয় পদ্ধতিতে টিকাদারের রোজগার খুব খারাপ হত না, তবে বছরে ১২,০০০ টাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। সাধারণত এদের আয় হত মাসে এক’শ টাকার নীচে।৫ প্রসঙ্গত, এই সময়ে অবস্থাপন্ন মানুষদের রোজগার কীরকম ছিল? এর ১৫ বছর আগে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির সময় ঐ মধুসূদন গুপ্ত ভারতীয় শিক্ষকদের মধ্যে সর্বাধিক বেতন পেতেন, মাসে ষাট টাকা, আর সাহেব অধ্যক্ষ পেতেন তাঁর কুড়িগুণ, মাসে ১২০০ টাকা।

মধুসূদন গুপ্তের বক্তব্যের পরে লেখক বিনয়ভূষণ তাঁর নিজের বয়ানে কথা বলছেন। তার মধ্যে দু-একটা উল্লেখযোগ্য লাইন এইরকম—
“শহর অথবা গ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিচু শ্রেণীর হিন্দুদের অবস্থাও একইরকম ছিল। অন্য পরিবারে বাংলা টিকার দৌলতে তদের মধ্যেও বসন্তরোগ সংক্রামিত হত। কারণ টিকাকর্মীরা তাদের পাশের কোনও পরিবারের শিশুকে যখন টিকা দিত তখন ওই রীতি ও নীতি অনুসারে সেই শিশু আক্রান্ত হত এবং মহামারী হিসেবে তা ছড়িয়ে পড়ত।”

বিনয়ভূষণ রায়ের বইটি অত্যন্ত তথ্যবহুল, খুবই পরিশ্রম করে লেখা আকর পুস্তক, কিন্তু সেখানেও দেশীয় পদ্ধতিতে টিকাকরণ এলো কেবলমাত্র নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে। মধুসূদন গুপ্ত সে-সময়ে কথাগুলি ভুল লেখেন নি, কিন্তু তার আগে কয়েক শতক ধরে দেশীয় পদ্ধতি যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে এসেছে তার উল্লেখ বিনয়ভূষণ কোথাও করলেন না। আর নারায়ণ চন্দ্র চন্দ-র বইটি একটি গবেষণাধর্মী বই, রবীন্দ্র পুরষ্কারে ভূষিত, সেটিতে ভারতে গুটিবসন্তের চিকিৎসার উল্লেখ করা হল, কিন্তু দেশীয় টিকা সম্পর্কে লেখক আদৌ অবহিত বলে মনে হল না। অথচ দেশীয় টিকার গুণ না জানার কথা নয়! এটা জানতে কোনো প্রাচীন পুঁথি পড়তে হয় না, কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে যোগ দিতে হয় না। ঊনবিংশ শতকে বাংলায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে বেশ কয়েকটি পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছিল, তাতে এই টিকা নিয়ে আলোচনা যথেষ্ট হয়েছিল, সেগুলি সমস্ত পাঠাগার থেকে হারিয়ে যায় নি, এমনকি সেগুলি সংকলিত করে বই বেরিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রদীপ বসু সম্পাদিত “সাময়িকী পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন” প্রথম খণ্ড (আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৮) দেখতে পারি। “চিকিৎসক ও সমালোচক” সাময়িকপত্রে লেখা শ্রীসৌরীন্দ্রমোহন গুপ্তের লেখা “প্রাচীন আর্য্যচিকিৎসা বিজ্ঞান” প্রবন্ধটিতে আর্যদের চিকিৎসা ও আয়ুর্বেদ সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা আছে, সেগুলো বিশ্বাস করার দরকার নেই। কিন্তু সেখানে একটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছিল।

“ধেন্যস্তন্য মাণ্ডুচি বা নরাণাঞ্চ মসিচিকা
তাজ্জলম বাহুমূলাচ্চ শাস্ত্র তেন গৃহীতবান।

বাহুমূলে চ শস্ত্রাণি রক্তোৎপত্তি কয়েরঃ চ,
তাজ্জলম রক্ত মিলিতেব স্ফোটকজ্বরঃ সম্ভবেৎ।”
শ্রীসৌরীন্দ্রমোহন গুপ্ত এর অর্থ করেছেন—

“গরুর বাঁট হইতে কিম্বা মনুষ্যের স্কন্ধ হইতে কফোনি পর্য্যন্ত, কোন বসন্ত হইতে, ছুরিকা করিয়া বীজ গ্রহণ পূর্ব্বক, অস্ত্র দ্বারা স্কন্ধ হইতে কফোনির যে কোন স্থানে একটু বিদ্ধ করিয়া দিলে রক্ত বাহির হইবে, তারপর তৎস্থানে সেই বসন্তের বীজ প্রয়োগ করিয়া দিলে জ্বর উৎপন্ন হইবে। তারপর স্থানান্তরে সেই বীজ প্রয়োগে গাত্রে স্বাভাবিক বসন্তের ন্যায় বসন্ত উৎপন্ন হইবে কিন্তু জ্বর হইবে না, সুতরাং কোনও প্রকার ঔষধেরও আবশ্যক নাই এবং রোগীকে ইচ্ছানুরূপ পথ্যও প্রদান করা যাইতে পারে। … একবার পূর্বোক্তরূপ টিকা প্রদান করিলে, সমস্ত জীবনে আর বসন্ত হইবার ভয় নাই…।”

এই শ্লোকটি অর্বাচীন হতে পারে, বা সৌরীন্দ্রমোহন গুপ্তর দাবি বাড়াবাড়ি হতে পারে। মূল কথা হল ১৮৯৫ সালেও অন্তত বৈদ্যসমাজে দেশীয় পদ্ধতিতে টিকা দান অর্থাৎ ভ্যারিওলেশনের পক্ষে লেখালেখি চলেছে, কিন্তু তার এক’শ বছর পরে আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষকরা এ ব্যাপারে এমন উদাসীন বা অজ্ঞ হয়ে পড়লেন যে, হয় ভ্যারিওলেশনের একদা-প্রবল অস্তিত্ত্বই তাঁরা ভুলে গেলেন কিংবা তাকে কেবলমাত্র নেতিবাচক কাজ বা কুসংস্কার হিসেবে চিহ্নিত করলেন।

অনেকে বলেন ইংরেজরা আমাদের পদ্ধতি ‘চুরি করে’ ভ্যাক্সিন বানিয়েছিল। তাঁরা এটা খেয়াল করেন না, ভারতে বা চীনে দেশীয় পদ্ধতি কয়েক শতক ধরে থাকা সত্ত্বেও তার থেকে নিরাপদ টিকা আবিষ্কারের দিকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এর কতগুলো সামাজিক রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কারণ ছিল। ছোট ছোট গণ্ডীবদ্ধ সমাজ ও রাজত্ব, নানা জাতের টিকাদারদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের অভাব ও ফলে টিকার তত্ত্ব নিয়ে কোনো নতুন ধারণা না গড়ে শীতলাপূজা আর আপ্তবাক্য আওড়ানো, ইউরোপের বৈজ্ঞানিক সোসাইটির মতো কিছুর অভাব, ইত্যাদি। কিন্তু বিপরীতে, যাঁরা জেনারের ভ্যাক্সিনকে একান্ত পাশ্চাত্যের দান বলে ভাবেন, তাঁরাও কি ইতিহাসকে অস্বীকার করেন না? মজা হল, দেশীয় টিকার ইতিহাসকে এমনকি চেষ্টা করে অস্বীকার করার কাজটুকুও করতে হয়না, কেননা এই ইতিহাসটাই লোপাট হয়ে গেছে! এবং সেই লোপাট করার কাজটা ইউরোপীয়রা একা করেনি। করেছে আমাদের ইউরোপ-মুখী দৃষ্টিভঙ্গিও।

এই করোনা-কালে, এই আকালে আমরা কি কেবল ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকার হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করতে কোনো ভাবনাই ভাবব না? নাকি, ভ্যারিওলেশনের মতো অত্যন্ত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কর্মপ্রণালীর সঙ্গে আমরা যেমন সেকালে শীতলাপুজোর মন্ত্র মিশিয়েছিলাম, আজও আমরা বৈজ্ঞানিক ওষুধের সঙ্গে গঙ্গাজল মিশিয়ে এক বিরিঞ্চিবাবা-ককটেল তৈরির সাধনায় মগ্ন থাকব?

সাধারণভাবে ভারতীয়দের ধারণা হলো যে, আমরা করোনা অতিমারীর মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করতে পারব না। অথচ বিগত শতকের চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপির মূল কাজটা ভারত আর বাংলাদেশের গবেষকরাই করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের আত্মবিশ্বাস এতই কম যে আমরা এর মধ্যেই সেকথা ভুলেছি।

দু’শ বছরের বেশি আগে ভারতীয় টিকা বা ভ্যারিওলেশন-এর বিবরণ ইংরেজরা লিখে প্রবল আগ্রহের সঙ্গে নিজের দেশে পাঠাত। জেনার তাঁর ভ্যাক্সিন নির্মাণে প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতি থেকে মূল সূত্রটি পেয়েছিলেন, সেটা আমাদের মনেও থাকেনি।

জন জেফানিয়া হলওয়েল। সংক্ষেপে কেবল হলওয়েল সাহেব। ইনি আমাদের পরিচিত, এবং অপছন্দের মানুষ। ভারতে এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন হয়ে। তাঁর কুখ্যাততম গ্রন্থ হল “অন্ধকূপে ইংরেজ ভদ্রলোক ও অন্যান্যদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সত্য কাহিনী”। তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের কলঙ্কিত করতে সত্যমিথ্যার মিশেলে লেখা বই। এই বই ইংল্যান্ডে প্রচারিত হয় ও ইংল্যান্ডের শিক্ষিত মানুষের কাছে সিরাজউদ্দৌলা তথা ভারতীয় সমস্ত শাসক নিষ্ঠুর নরঘাতী বিশ্বাসহন্তা প্রতিভাত হন। ডাক্তার হলওয়েলকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়ামের কাউন্সিলের সদস্য করে। তারপর পলাশীর যুদ্ধের পরে ক্লাইভ ফিরে গেলে হলওয়েল সাময়িকভাবে বাংলার গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব নেন।

চিত্র ৭ – জন জেফানিয়া হলওয়েল (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)

কিন্তু ধান ভাঙ্গতে শিবের গীত কেন? গুটিবসন্ত বা তার টিকার সঙ্গে হলওয়েলের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে। হলওয়েল সাহেবের কপালে বাংলার গভর্নরের পদ বেশিদিন টেকেনি। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান, আর নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ নানা কাহিনী লিখে প্রকাশ করতে থাকেন। ১৭৬৭ সালে হলওয়েলের লেখা গুটিবসন্তের টিকার বিবরণ হচ্ছে এ-বিষয়ে ইউরোপীয়দের বিবরণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন।

কী লিখেছিলেন হলওয়েল?

‘ব্রাহ্মণদের বিশেষ গোষ্ঠি … প্রতি বছর এই কাজ করত… বৃন্দাবন, বারাণসী ও এলাহাবাদ থেকে ছোট ছোট দলে [গুটিবসন্ত] রোগের সময়ের আগে এসে…।… একটা ছোট যন্ত্র দিয়ে তারা [চামড়ায়, সাধারণত হাতে] সামান্য রক্ত বেরনোর মতো ক্ষত করত, তারপর তারা দুভাঁজ করা কাপড়ের বটুয়া (যা তারা তাদের কোমরের কাপড়ে সবসময় বেঁধে রাখত) থেকে ছোট একটুকরো তুলোয় করে গুটিবসন্তের জিনিস দু-তিন ফোঁটা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে, ঐ ক্ষততে লাগাত, তারপর একটা সামান্য ব্যান্ডেজ দিয়ে দিত, হুকুম করত যেন ছয়ঘন্টার মধ্যে ঐ ব্যান্ডেজ খোলা না হয়।৬

গর্ভবতী নারী, আগে টিকা পায়নি এমন মানুষ, যাদের গুটিবসন্ত হতে পারে তেমন লোকদের সদ্য টিকা দেওয়া মানুষের কাছাকাছি আসতে বারণ করা হত-কারণ কাছাকাছি এলে তাদের গুটিবসন্তের খারাপ আক্রমণ হতে পারত। যাকে টিকা দেওয়া হত তার খাবারদাবার সম্পর্কে কঠিন বাধানিষেধ আরোপ করা হত। টিকা দেবার পরে তার গায়ে যতদিন জ্বর না আসছে ততদিন তাকে বারবার ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো হত, আর সাধারণত ছ’দিনের মাথায় জ্বর আসত। তখন দিন-তিনেক স্নান বন্ধ রাখা হত। তারপর গুটি বেরত। তখন আবার যতদিন গুটি পেকে খোসা না উঠছে, ততদিন বারংবার স্নান করানো শুরু হত। সেই সময় কাঁটা দিয়ে গুটির পুঁজ বের করে রোগীর কষ্ট দূর করা হত, আর পরের বছর টিকা দেবার মালমশলা সংগ্রহও হত। টিকা দেবার জিনিসটি সর্বদা আগের বছর সংগৃহীত রস, যা শুকিয়ে রাখা হত।

হলওয়েল লিখেছেন, কেবল দক্ষ ব্রাহ্মণেরা টিকা দেবার কাজ করতেন। সাধারণত তাঁরা এলাহাবাদ, বারাণসী, বৃন্দাবন প্রভৃতি সুদূর হিন্দু পবিত্রভূমি থেকে আসতেন। টিকা দেবার পুরো সময়টাতে তাঁরা ‘অথর্ব বেদ’-এর মন্ত্র পড়তেন। হলওয়েল সাহেবের উদ্দিষ্ট পাঠকরা ছিলেন ব্রিটিশ ডাক্তার, বিশেষ করে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যরা। হলওয়েল যখন লিখছিলেন তখন একই ভ্যারিওলেশন পদ্ধতি তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ডে ঢুকেছে, তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে ইংরেজ ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল। ভ্যারিওলেশন হিন্দু সমাজের মাথা অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের কাজ, বেদমন্ত্র পাঠের সঙ্গে করা হত, এমন বললে ইংরেজ ডাক্তারদের কাছে এটি বেশি গ্রহণযোগ্য হত। ভারত সম্পর্কে যেসব ইংরেজ ডাক্তার খবর রাখতেন, তাদের কাছে ব্রাহ্মণদের পরিচয় ছিল সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে। আসলে কিন্তু ভ্যারিয়েলেশন কেবল ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া ছিল না, আর পদ্ধতিটি সবসময় একই রকম থাকত না। সে কথায় পরে আসব।

হলওয়েল ছাড়াও আরও কিছু ব্যক্তির এই বিষয়ে ইংরাজিতে লেখা পাওয়া গেছে। এমন একজন হলেন রাধাকান্ত দেব। হলওয়েলের বিবরণের প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৩১ সালে রাধাকান্ত লিখেছেন:

“ফাল্গুন মাসের কোনো পবিত্র দিনে সুস্থ বাচ্চা ছেলে বা মেয়েকে টিকাদারেরা টিকা দিত। তাদের ওপরহাতে ছুঁচলো কোনো জিনিস বিঁধিয়ে দেওয়া হত, আর আগে তুলোতে লাগিয়ে রাখা পুঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। পুঁজ সংগ্রহ করা হত আগের কোনো প্রাকৃতিক গুটিবসন্তের পাকা গুটি থেকে। বাচ্চাদের জ্বর না আসা পর্যন্ত বারবার স্নান করানো আর ঝাল ও রসাল খাবার খাওয়ানো হত, ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে জ্বর আসত আর গুটিবসন্ত বের হত। তার তিনদিনের মাথায় জ্বর চলে যেত, গুটিগুলো থাকত, আর [গুটি বেরনোর] পঞ্চমদিনে সেগুলোর ওপর জল ঢেলে সেগুলো ভালভাবে বের করা হত। সাতদিনের মাথায় গুটির ওপরে কাঁচাহলুদ মাখানো হত যাতে সেগুলো তাড়াতাড়ি পাকে। নবম বা দশম দিনে গুটিগুলো পাকত, তখন বৈঁচির কাঁটা দিয়ে সেগুলো ফুটো করে দেওয়া হত। এই হল চিকিৎসা, আর এটা তিনসপ্তাহের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হত, আর রোগী দিব্যি ভাল হয়ে যেত। পুরো সময়টা রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকেদের খুব সাবধানে ও আলাদা ঘরে রাখা হত। কোনো অপরিচ্ছন্ন মানুষকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হত না। রোগীর বাবা-মা আর বাড়ির লোকেরা শুচিভাবে থাকতেন, আর দেবী শীতলার পুজো করতেন-শীতলা হলেন বসন্তরোগ আদি গায়ে ফুটে বেরনোর রোগসমূহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। টিকাদারদের বাড়ির অবস্থা অনুযায়ী পারিশ্রমিক দেওয়া হত, তবে সাধারণত দরিদ্ররা টিকা পিছু একটাকা আর অবস্থাপন্নরা দু’টাকা দিতেন।”

দেখা যাচ্ছে টিকা দেবার মূল ব্যাপারটা হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব মোটামুটি একরকমই বলেছিলেন। কিন্তু ডিটেলে তফাৎ আছে। রাধাকান্ত অথর্ববেদের মন্ত্র আওড়ানোর কথা বলেন নি, দূরের হিন্দু তীর্থস্থান থেকে ব্রাহ্মণ এসে টিকা দেবার কথা বলেন নি, আর শীতলার পুজোর কথা বলেছেন। এ’দুজন ছাড়া অন্য লেখকদের লেখাও আছে। সব মিলিয়ে, এখন মূল বিতর্ক হল টিকাদেবার জিনিসটা কী, তাই নিয়ে। হলওয়েল আর রাধাকান্ত দেব দুজনেই বলছেন তুলোয় টিকার বীজ থাকত, আর টিকা দেবার পরে গায়ে গুটি বেরোলে তার পুঁজ সংগ্রহ করা হত, যা দিয়ে অন্যদের টিকা দেওয়া হত। তবে,

• যে বছর গুটি থেকে রস সংগ্রহ করা হত, সে বছরই সেই রস টিকার মাধ্যমে অন্যের ওপর প্রয়োগ করা হত কিনা, এ-ব্যাপারে রাধাকান্ত দেব স্পষ্ট করে কিছু বলেন
নি।
• হলওয়েল এবং অন্য কয়েকজনের বক্তব্যে আমরা দেখছি, আগের বছরের গুটির রস নিয়ে টিকা দেওয়া হত।
• আবার অন্য লেখাতে পাচ্ছি, একজনকে টিকা দিয়ে সে-বছরই সেই রোগীর গুটির রস টিকা হিসেবে ব্যবহার করা হত।

এখন এই সিদ্ধান্ত সমগ্র প্রক্রিয়াটির ক্ষেত্রে কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। টিকার রস কয়েকদিনের মধ্যে ব্যবহার করলে তাতে অন্য জীবাণু (বিশেষ করে টিবি ও সিফিলিস) বেঁচে থাকার ও সেইসব রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। আবার, একবছর পরে ব্যবহার করলে যেমন সে সব জীবাণু মরে যাবে, তেমনই আবার গুটিবসন্তের বীজাণু নিজেও না বেঁচে থাকতে পারে, বা কম সংখ্যক হয়ে যেতে পারে, এমনকি কমজোরিও হয়ে যেতে পারে। তাতে টিকা জনিত গুটিবসন্তের প্রাবল্য কমার কথা। আবার গুটিবসন্তের বীজাণু খুব কমে গেলে, টিকাতে কাজ হবে না।

টিকার পদ্ধতিতে আরও কিছু রকমফের ছিল। ‘নীচু’ ব্রাহ্মণ ছাড়াও মালাকার/মালি, কুম্ভকার, শঙ্খকার, তাঁতি, নাপিত ইত্যাদিরা টিকা দেবার কাজ করতেন। এঁদের অধিকাংশই কাছেপিঠের শহর-গ্রাম থেকে আসতেন, বারাণসীর মতো দূরদেশ বা ‘পবিত্রভূমি’ থেকে আসা টিকাকার কমই ছিল। তবে টিকা নেবার ব্যাপারে জাতিভেদ ছিল। উঁচু জাতের বালকের হাতে টিকা দিয়ে সেই টিকার স্থানে হওয়া ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে টিকা দিতে চাইতেন সকলে। আগের বছরের গুটিবসন্তের গুটি থেকে রস সংগ্রহ করে রাখা ও পরের বছর সেই রস দিয়ে টিকা দেওয়া চলত। আবার একজনের (সাধারণত ব্রাহ্মণ বালকের) হাতে টিকা দিয়ে তার টিকার জায়গাটা দিন আট-দশ পরে ফোঁড়ার মতো পেকে গেলে সেই জায়গা থেকে রস নিয়ে সেবছরই অন্যদের টিকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও প্রচলিত ছিল ।

আগে দেখেছি ইউরোপ এই ভ্যারিওলেশন টিকা নিয়ে গুটিবসন্তের প্রকোপ থেকে খানিকটা রক্ষা পায়। ভারতে এই টিকা কতটা চালু ছিল? ব্রিটিশ-পূর্ব ভারত নিয়ে তেমন তথ্য জানা নেই, কিন্তু ব্রিটিশ আসার পরে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য আছে।

পরবর্তী অধ্যায়ের লিংক: গুটিবসন্তের টিকা-ভারতীয় ভেরিলেশন ও জেনারের ভ্যাক্সিন (চতুর্থ এবং শেষ অধ্যায়)

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।