অর্ধেক আকাশ আর অর্ধেক পৃথিবী
আজকাল অনেকে ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ বলে অভিহিত করছেন বলে দেখতে পাচ্ছি। এর অন্যতম কারণ হিসাবে তাঁরা প্রাচীন ভারতের গণরাজ্য বলে অভিহিত কয়েকটি জনপদে একক বংশানুক্রমিক শাসকের অনুপস্থিতির উল্লেখ করেন। কিন্তু, ভারতের এই প্রাচীন গণরাজ্যগুলিতে জননীদের রাজনৈতিক অধিকারের কোনও চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতের প্রাচীন যুগে রচিত ধর্মশাস্ত্রে দেখি সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বা সামাজিক অধিকার, নারীদের কোথাও স্থান নেই, নেই তাঁদের বেদ শিক্ষার অধিকার। আদি মধ্যযুগের স্মৃতিশাস্ত্রে সম্পত্তির অধিকার কিছুটা যদি বা নারীদের দেওয়া হল, তো সংযোজিত হল বিধবাদহনের মতো অমানবিক প্রথা। বাস্তবিকভাবে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ভারতের কোনও ধর্মীয় আবহেই নারীদের গৃহের অভ্যন্তরে সন্তান উৎপাদনের উপায়ের বেশি কিছু দেখা হয়নি। মধ্যযুগের ইতিহাসে বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকজন নারীর নাম রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে দেখা গেলেও সামগ্রিক ভাবে নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ পথ পরিবর্তনের প্রথম আলোকবর্তিকা। বিগত কয়েক দশকে ভারতের কৃষক ও শ্রমিক, দলিত ও আদিবাসীদের সংগ্রামের নেতৃত্বে নারীদের উপস্থিতি দিন বদলের ইঙ্গিত বহন করছে। ভারতের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া জগতে ধীরে হলেও নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু, এখনও ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনায় নারীদের সমান অধিকারের ধারণা স্বীকৃতি লাভ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
ভারতে স্বাধীনতার পর গণতন্ত্রের সাত দশক অতিবাহিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী নারীদের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদে দেখা গেলেও ভারতের রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে আজও নারীদের প্রতিনিধিত্ব নাম মাত্র। ভারতের সংসদ ও রাজ্যের আইনসভায় নারীদের জন্য সংরক্ষণ নারীদের জন্য সত্যিই কবে অর্ধেক আকাশ আর অর্ধেক পৃথিবীর অধিকার এনে দিতে পারবে, তা বলা কঠিন। তবে, ভারতের রাজনৈতিক ও পুর সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন না হলে বাস্তবে খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যাবে বলে মনে হয় না।
বিগত কয়েক দশকে ভারতের ইতিহাস চর্চার সময় সমাজের বিভিন্ন বর্গের কথা পৃথক ভাবে গবেষণা শুরু হয়েছে, ক্রমশ গুরুত্ব পেয়েছে স্থানিক ইতিহাস চর্চা। কিন্তু, ভারতের নারীদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা এখনও খুব বেশি দূর পর্যন্ত যায়নি, যতটুকু লেখা হয়েছে তারও অধিকাংশ আধুনিক যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলা ভাষায় ভারতের নারীদের ইতিহাস নিয়ে চর্চার কাজ এখনও বিশেষ এগোয়নি। ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ গোষ্ঠী অদূর ভবিষ্যতে এই কাজে দায়িত্বের সঙ্গে এগিয়ে যাবে, সচেতমন পাঠকদের কাছ থেকে চাই তার জন্য সহযোগিতা।